:: আরিফুল হক ::
আজকের মত বাংলার মাটি বন্ধ্যা ছিলনা । শতশত নয় , হাজার হাজার বীর সন্তানের জন্ম দিয়েছে এই বাংলার মাটি , যারা মুসলমান শাসনের,এবং ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য বীর মুজাহিদের মত অকাতরে প্রান বিলিয়ে দিয়েছেন । তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনের যদি নাম বলতে হয় তাহলে প্রথমেই মনে পড়ে, ২৪ বছর বয়সী তরুন তাজা প্রান , যিনি মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন ক্ষমতার মসনদে থেকে বিদেশী আগ্রাসী শক্তির সাথে, পাঁচ পাঁচটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঘোড়ার উপরে ছুটে ছুটে জীবন কাটিয়ে অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২রা জুলাই শাহাদত বরন করেন ।তার নাম সুবেবাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব,মনসুর উল মূলক সিরাজউদ্দৌলা মির্জা মোহাম্মদ হয়বত জঙ্গ বাহাদুর ! মুর্শিদাবাদে সিরাউদ্দৌলার পতন মানে শধু ভারতে মুসলমান শাসনের পতন ছিলনা , বিশ্বের তাবৎ মুসলমান শাসন পতনের সূচনা করেছিল।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধে সিরাজের পতনের পরদিন থেকেই সারা ভারতে মুসলমানরা স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াইএ নেমে পড়ে । তাদের সাথে বাংলার বীর সন্তানরাও পিছিয়ে থাকেনি !
১৭৮২-৮৩ সালে রংপুর কৃষক বিপ্লবের মহানায়ক বীরকৃষক যোদ্ধা নুরুল দীন এর নাম হয়ত আমরা ভুলে গেছি । কিন্তু তিনি দিনাজপুরের (মহারাজা) পলাশী চক্রান্তের হোতা বিশ্বাসঘাতক দেবী সিং কে দেশছাড়া শুধু নয় ,তাকে সাহায্যকারি লর্ড হেষ্টিংসের কামান বন্দুক সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকেও নাস্তানাবুদ করে ইতিহাসে সাহসের বাতিঘর হয়ে জ্বলছেন !
আর এক বীর যোদ্ধা ,বাঁশের কেল্লা খ্যাত হাফেজ মওলানা নিসার আলি (তিতুমীর) ও তাঁর সহযোগী মাসুম আলি , মিসকিন খা । মওলানা শরীয়তউল্লাহ । তাঁর পুত্র মওলানা আলাউদ্দিন (দুদু মিয়া )। দুদু মিয়ার দুই পুত্র বিপ্লবী গিয়াসুদ্দিন হায়দার ও আব্দুল গফুর।বিপ্লবী মজনু শাহ ।১৮৫৭ সালে বৃটিশ শাসনে দাবালন সৃষ্টিকারি ,সিপাহী বিপ্লবের স্পার্ক প্লাগ নামে পরিচিত , বহরমপুর মুর্শিদাবাদের বৃটিশ ছাউনির বিপ্লবী সিপাহি মেজর মুরাদ বক্স ।যিনি সিপাহী বিপ্লবের সূচনা করেন । ১৮৫৭ র চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও ট্রেজারি দখলের মহাবিপ্লবী হাবিলদার রজব আলি ।কত নাম ! কি মহিমান্বিত সেই সব ইতিহাস !
দীর্ঘদিন পর, ইতিহাসের মহিমান্বিত নায়কদের উত্তরসূরি হয়ে, বিংশ শতাব্দীর পাদপ্রান্তেএসে বাংলায় জন্মনিল আর এক শ্রেষ্ঠ ক্ষণজন্মা মহাপুররষ , তিনি শহীদ প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ।
জিয়াউর রহমান শুধু একটি নাম নয় ,একজন পরিপূর্ন মানুষ । তিনি সাহসী যোদ্ধা , সৎ নেতা , দূরদর্শী রাজনীতিবিদ , জনবান্ধব শাসক, বুদ্ধিদীপ্ত পলিসি মেকার , সবার উপর তিনি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাযোদ্ধা। আজ আমি তাঁর বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্ব বিচ্ছুরিত মহান আত্মত্যাগের কিছু কাহিনী তুলে ধরবার চেষ্টা করবো ।
১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত রাজনীতিবিদরা দেশবাসীকে স্বাধীনতার ললিপপ দেখিয়ে বোঝালো, স্বাধীনতা আসছে , আসছে ! স্বাধীনতার ডঙ্কায় গমগম করছে দেশ । ‘৭১ এর ৭ মার্চ বড়নেতা আঙুল উঁচু করে জনগণকে বললেন,”এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” তিনি ঘরেঘরে দূর্গ গড়ে ,কাস্তে, কোদাল, বটি খুন্তি ছুরি হাতুড়ী নিয়েও রেডি থাকার নির্দেশ দিলেন । তারপর করলেন ,কত সিটিং আর কত মিটিং ।প্রতিদিনই শোনালেন Wait and see। স্বাধীন গদীর আশায় পাতিনেতারা গাঁওগেরামে বউ বাচ্চা ফেলে ঢাকায় এসে ওঁত পেতে বসে থাকলো , কখন জানি শিকে ছিঁড়ে সেই আশা নিয়ে ।
এল ২৫ মার্চ ‘৭১ । শিকে ছিড়ে স্বাধীনতা এলনা , এল কামানের আগুনের গোলা , মর্টারের শেল , ভারি রাইফেলের গুলি, ট্যাংকের বুক কাঁপানো আওয়াজ । পুড়তে লাগলো নিরীহ মানুষের ঘর দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ,পুলিশ বিডিআরের ছাউনি । লাশে লাশে ভরেগেল রাস্তাঘাট নদী নালা ডোবা বাজার । রণংদেহি নেতারা রাতের আঁধারে লুঙ্গী পরচুলা পরে নিরাপদ দেশে পালাল ! মরতে থাকল সাধারন মানুষ । দেশব্যপী কান্না হাহাকার, লাশ আর আর্তনাদ !
জাতির এমনি এক দুঃসময়ে মুক্তিদাতার রূপ ধরে আবির্ভাব জিয়াউর রহমানের । তিনি পাকিস্তানি ট্যাংক কামানের মুখে বুকপেতে দাঁড়িয়ে শোনালেন -“We Revolt” ! শধু তাই নয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মত ‘ওয়ার্ল্ডক্লাস’ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বেতার কেন্দ্রে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে স্ব-নামে ঘোষনা করলেন জাতির প্রতিক্ষিত আকাঙ্খার বানী ,- “I Major Ziaur Rahman declear the Indipendence of Bangladesh .” কোন ছলচাতুরী নয় , একেবারে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষনা। দেশ শিহরিত হল,আপ্লুত হল, জাতি যেন তার আত্মার প্রতিধ্বনি শুনতে পেল । মুক্তি পাগল মানুষ ঘরছেড়ে দলেদলে বেরিয়েএল মুক্তির নেশায় ! এ যেন বিষ্ময় !একি কম সাহসের কাজ !
প্রাথমিক ভাবে শত্রুর কেড়েনেয়া হাতিয়ার দিয়েই জিয়াউর রহমান ও তাঁর সাথীরা শত্রুর মোকাবিলা করতে লাগলেন ! তারপর —
Z Force
Ziaur Rahman নামের আদ্যক্ষর Z নিয়ে নামাংকিত , স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম নিয়মিত পদাতিক ব্রিগেড ! গেরিলা ট্যাকটিসের বদলে, পাকিস্তান বাহিনীকে সরাসরি যুদ্ধে মোকাবিলা করার উদ্দশ্যে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হল এই Z Force।
১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সংযুক্ত করে গঠিত জেড ফোর্স ২৫জুন’৭১ এর মধ্যে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ১ম পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে সুসংগঠিত হল!
সংগঠিত হয়েই ২৫জুন থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত গারোপাহাড়ের কোলে ,মশা সাপ বন্যশূকর ভরা গহীন জঙ্গলাকীর্ন দূর্গম তেলঢালা নামক স্থানের প্রতিকুল পরিবেশে চললো সর্বাত্মক যুদ্ধের ট্রেনিং । ২৮ জুলাই ট্রেনিং শেষ হবার পরপরই জিয়াউর রহমান স্ট্রাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ কিন্ত ভীষন রকম বিপদজনক তিনটি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন । এই দুঃসাহসিক সিন্ধান্তে অনেকে আশংকিত হলেও , তিনি জিয়াউর রহমান , কাজে নেমে পিছিয়ে আসার মানুষ নয় ।বললেন “We have to show die hard stamina, Do or die energy .
কামালপুর অপারেশন
টাঙ্গাইল এবং ঢাকা সংযোগ সড়কের উপরে এই কামালপুর বিওপি ।ঢাকা অভিমুখে যেতে হলে কামালপুর বিওপি অবশ্যই দখল করতে হবে । কামালপুরে ছিল পাকিস্তান বাহিনীরও শক্ত ঘাঁটি ।এখানে আঘাত করা মানে বাঘের ডেরায় আঘাত করার সমান ! এখানে ছিল পাক আর্মির ব্রিগেডিয়ার কাদিরের ৯৩ ব্রিগেড, এবং ৩৩পাঞ্জাব , ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট, ইপি সিভিল আর্মড ফোর্স ও ১প্লাটুন রাজাকার ।আরছিল শক্তিশালী অস্ত্র গোলাবারুদের পাশাপাশি ৮১মি:মি: মর্টার !
অপরদিকে জিয়াউর রহমানের সাথে ছিলেন সর্বসাকুল্যে ৮৫০জন সৈন্য , ক্যাপ্টেন হাফিজ , ক্যাপ্টেন মাহবুব , ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ , মেজর মইন ও মেজর জিয়া স্বয়ং ! জিয়ার অবস্থান থেকে কামনের গোলা বর্ষনের মধ্য দিয়ে রাতে যুদ্ধ শুরু হল ! কামালপুরের যুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য নাইটমেয়ার হয়ে উঠলো। এই শক্তিশালী ঘাঁটিতে ৪বার মুখোমুখী যুদ্ধ হয়েছে , হিটএ্যান্ড রান যুদ্ধ হয়েছ ২০বার ।এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সৈন্য নিহত হয় । তারা ধারনাই করতে পারেনি এত অল্পপ্রশিক্ষিত সৈন্যদের দিয়ে জেডফোর্স এত শক্ত কামড় দিতে পারবে ।
কামালপুর যুদ্ধ ছিল জিয়াউর রহমানের সাহসিকতার অমর বীরত্ববিচ্ছুরিত, মহান আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত কীর্তি। এই যুদ্ধজয়ের পর জেনারেল মানেকশ হেলিকপ্টার নিয়ে জেডফোর্স হেডকোয়াটারে এসে বলেছিলেন, তার ধারনাতেই ছিলনা যে ZForce এমন অপারেশনের সাহস রাখে ।
”Z Force showed up real Tiger character “.
এটাতো মাত্র একটা অপারেশনের সংক্ষিপ্ত কাহিনী । আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের এহেন লোমহর্ষক দুঃসাহসিক অভিযানের ইতিহাস কালের অমোচনীয় কালি দিয়ে লেখা আছে ,বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট, নকশী , চিলমারি, টেংরাটিলা, ছাতক প্রভৃতি যুদ্ধের ইতিহাসে !
যারা মনেকরেন ‘এরিনমোর’ তামাকু সেবন করতে করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসে গেছে, সেইসব চেতনা উত্থিত নেংটিইদুঁরদের বলতে চাই , বাংলাদেশের জন্য জিয়াউর রহমানের অবদানের উচ্চতা মাপার মাপকাঠি ধরারও ক্ষমতাও তোমাদের নেই ! কলকাতায় ৫০০টাকা ভাতায় ,মদ টেনে যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েগেছে , তারাই বলবে , জিয়াউর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেননা ! সেইসব নেংটিইদুঁররাই জিয়া বীরউত্তম খেতাব কেড়ে নেয়ার ঔদ্ধত্য দেখাবে। তাতে জিয়ার সম্মানের কোন হানি হবেনা , বরং ‘বীরউত্তম’ পদকের মান ধুলায় লুন্ঠিত হবে !কারন জিয়ার সম্মান আরোপিত নয় , তাঁর সম্মান অর্জিত । জিয়াউর রহমান নামটাই মহান । He born great, He achieved greatness , He died as a great Shaheed (Immortal). May Allah give him best place in Jannat .
লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা