:: হাসান আল আরিফ ::
কলকাতা বাংলার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, যিনি জীবনমূখী গান গাওয়ার জন্যে খুবই বিখ্যাত- নচিকেতা’র একটি গান আছে, “বিজয়ীরা বরাবর ভগবান এখানেতে, পরাজিতরাই পাপী এখানে ! রাম যদি হেরে যেত, রামায়ন লেখা হত, রাবন দেবতা হত সেখানে ! কেন পথ নিয়ে মাথা ব্যাথা, জেতাটাই বড় কথা- হেরে গেলেই শেম শেম- ইটস এ গেম, ইটস এ গেম।।” ধারণা করি আজকের লেখার বিষয়বস্তু ধরে ফেলেছেন। হ্যাঁ- আজকে পরাজিতদের ইতিহাস লেখবো।
আপনারা প্রায়ই খেয়াল করে থাকবেন, আমি জার্মানী বিষয়ে খুব আগ্রহী। সেটা হিটলার, গোয়েবলস কিংবা হালের ক্রেজ ফুটবলের মিরোস্লাভ ক্লোসা কিংবা ওজিল যাই হোক না কেন!! মাঝে সাঝে নিজের প্রোফাইলও জার্মান রঙে রাঙ্গিয়ে দেই- এর পিছনে একটা মন:স্তত্ত্ব কাজ করে। জার্মানীর কারণেই ১ম বিশ্বযুদ্ধ ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস স্বীকৃত ভিলেন হিটলার। কিন্তু আমি আমার মনোজগতে ভিন্ন কিছু কল্পনা করি। আমি দেখি হিটলার নায়ক। ২য় বিশ্বযুদ্ধে যদি হিটলার সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির মাতৃভূমি বৃটেনের সূর্য ডুবিয়ে না দিতেন তবে অন্তত বিশ্বের বুকে ৫৭ টা মুসলিম দেশ একজন মুসলমান হিসাবে পেতাম কি না সন্দেহ আছে। যদিও হিটলারেরও একই পথে সাম্রাজ্যবাদী হওয়ার খায়েস ছিলো বলা চলে তথাপি চূড়ান্ত সফল না হওয়াতে ১০০% বেনিফিটেড হয়েছে মুসলিম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো- এজন্যে হিটলার আমার কাছে পরাজিত বীর।
জয়ীদের ইতিহাসগুলোই এমন ! পরাজিতদেরকে যতপ্রকারের কুৎসায় কুৎসিত করা যায় তার কমতি থাকে না। যেমন ধরুন, ইত্তেফাক পত্রিকার কথাই- আমরা সবাই জানি, ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। উনি সাংবাদিকতার জগতে দিকপালও। কিন্তু একবারের জন্যেও খুজে দেখি না- পত্রিকাটির অরিজিনাল ব্রান্ডভ্যালু কিন্তু মাওলানা ভাসানীর- তখন এটি সাপ্তাহিক ছিলো, ১৯৫৩ থেকে মানিক মিয়ার অধীনে দৈনিক হয়েছে। তথাপিও ভাসানীর জন্ম বা মৃত্যুদিনে ইত্তেফাকের ভেতরের পাতায় এক ইঞ্চির একটি অর্ধেক কলাম হয়তো দেখা যায় ! কারণ, ভাসানী এখন পরাজিতদের দলে তাই।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি, আপনারা বর্তমানে অনেকেই হয়তো জানেন- ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর আম্রকাননে ঔপনিবেশিক শক্তি সিরাজকে পরাজিত করে স্বাধীনতা হরণ করে। কিন্তু তখনকার বাস্তবতা কেমন ছিলো ?একটু চোখ রাখা যাক। সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর প্রথম ইতিহাস লেখা হয় ১৭৬৩/৬৪ সালে। সেখানে ভিলেন কে জানেন ? হ্যাঁ- সিরাজ নিজেই। ইউসুফ আলী খাঁনের লেখা “তারিখ ই বাঙ্গলাই মহব্বতজঙ্গী” বইয়ে যাবতীয় ঘটনার জন্যে সিরাজকে দায়ী করা হয়েছিলো। তার পরবর্তীতে ১৭৮০/৮১ সালে রচিত হয় সিয়ার-উল-মুতাখ-খিরীন যার রচয়িতা সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ি। তিনি লেখে গেছেন, ” ‘এই জাতি (ইংরেজ) কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না।” সিরাজের প্রতি অসম্ভব রকমের ঘৃণা লেখে গেছেন আমাদের দেশীয় লেখকেরা- কারণ, সিরাজ যে পরাজিত ! তার পরবর্তিতে মুনশি গোলাম হোসেন সলিম এর লেখা রিয়াজ-উস্-সালাতিন গ্রন্থ যা প্রকাশ পায় ১৭৮৬ সালে- সেখানে লেখা হয়, ‘তারা (ইংরেজরা) উদার, বিশ্বস্ত, সহনশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতারণা কাকে বলে তা তারা জানে না। শঠতা ব্যাপারটাই তাদের কাছে অজানা।‘ সিরাজকে পূর্বের মতই আরেক বার মরতে হয়েছে যেভাবে নৃশংসতায় মোহাম্মদীবেগের হাতে মিরনের নির্দেশে মরতে হয়েছিলো। অথচ রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করে গেছেন যে, সে শঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবুও কলমের খোঁচায় সিরাজকে এভাবে বার বার মরতে হয়েছিলো।
রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের লেখা “মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতং” (১৮০৫) কিংবা কবি নবীনচন্দ্র সেন-এর “পলাশী যুদ্ধ পাঠ” (পলাশীর ১০০ বছর পরে ১৮৫৭ সালে), অথবা পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের লেখা “রাজাবলী” রচনাগুলি পড়লে আপনার মনে হবে সিরাজকে কেবল হত্যা করাই ঠিক হয়নি তার লাশ কয়েকশ বছর ঝুলিয়ে রাখা উচিত ছিলো !! এমন বিদ্বেষপূর্ন ইতিহাস সিরাজের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছিলো। অথচ বাংলা যেখানে পরাধীন হয়ে গেলো, ঔপনিবেশিক শাসনে বাধা পরলো এসবে কোন টু শব্দটিও নেই। সিরাজের পক্ষে প্রথম কলম ধরেন, সিরাজের পতনের ১৩৯ বছর পরে ১৮৯৮ সালে শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্র তার “সিরাজউদ্দৌলা” বইয়ে। চিন্তা করা যায় ?? ঘটনার ১৩৯ বছর পরে ইতিহাসের আসল মুল্যায়নের জায়গা তৈরী হয়: বাঙ্গালী কতটা আত্মকেন্দ্রীক !! এর পরের ধারাবাহিকতায় আমরা এখন জানি সিরাজ ভিলেন নয়, বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা করা অনন্য বীর। এভাবেই ১৩৯ বছর ঢাকা ছিলো পরাজিতদের ইতিহাস। ইতিহাসে পরাজিত অনেক খ্যাতিমানের অনেক না বলা কথা আছে, এমন ছোট মিনি ব্লগে লেখে বুঝানো কঠিন। অন্য আরেকদিন আরো হবে, ইনশাল্লাহ।
গত ২৯ জানুয়ারী ২০১৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) সম্মেলন কক্ষে তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়নস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ স্যার একটা কথা বলেন, ‘ইতিহাসের সঙ্গে ক্ষমতার একটা সর্ম্পক আছে। সে ক্ষমতায় যারা বিজয়ী হয় তারাই ইতিহাস রচনা করে। পরাজিতরা ইতিহাস রচনা করে না। আর বিজয়ীরা তাদের মতো করে, তাদের অবস্থানে থেকে ইতিহাস রচনার চেষ্টা করে থাকে।’ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এই তত্ত্বটি অসম্ভব রকমের সংগতিপূর্ণ। কিভাবে ? খেয়াল করুন- বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগের একটি তুরুপের তাস হলো, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধচারণকারী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। এর জবাব বিএনপি নেতৃবৃন্দ কোনপথে দিবে হয়তো ভাল জানা নাই। তাই হজম করে চুপ থাকতে হয়। কিন্তু অনেক বিএনপি নির্ধারকও জানেন না শাহ আজিজুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠার আধিপন্ত্য ! কারণ জয়ীদের লেখা ইতিহাসই যে আমরা জানি !
“১৯৭৩ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলো শাহ্ আজিজুর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণহত্যা অস্বীকার করেন। মুজিব শাহ্ আজিজকে জেল থেকে ছাড়িয়ে তার সরকারের কূটনৈতিক বানান। তাকে ঐ আমলে বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটা গাড়ী কিনে দেন এবং তার পরিবারকে মাসিক তিন হাজার টাকা ভাতা দেন।” (সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৬শে মার্চ ২০০৮) ১৯৭৪ সালে শেখ সাহেব যে ওয়াইসি সম্মেলনে পাকিস্তান যায় তার প্রধান ক্রিড়ানক এই ব্যক্তি। অসমর্থিত মাধ্যম (আমি রেফারেন্স পাইনি, তাই) বলে শাহ আজিজুর রহমান শেখ সাহেবের সাথে পাকিস্তানও গিয়েছিলেন সেই ওয়াইসি সম্মেলনে। এছাড়াও আমি কোথায় যেনো পড়েছি, (মনে করতে পারছি না, মনে হলে রেফারেন্স এডিট করে ঢুকিয়ে দিবো) শেখ সাহেব শাহ আজিজকে গণপূর্ত/পানি বোর্ডের চেয়ারম্যানও করেছিলেন। অথচ যত দোষ জিয়ার ! “কৃষ্ণ করলে লীলাখেলা, অন্যে করলে পাপ” এমন অবস্থা ! অথচ রাজাকার বাহিনির উপপ্রধান ফিরোজ সালাউদ্দীনকে যে শেখ সাহেব নিজেই পদায়ন করেছে তার টু শব্দটিও ইতিহাস করে না!
জয়ীদের ইতিহাসগুলোই এমন ! পরাজিতদেরকে যতপ্রকারের কুৎসায় কুৎসিত করা যায় তার কমতি থাকে না। যেমন ধরুন, ইত্তেফাক পত্রিকার কথাই- আমরা সবাই জানি, ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। উনি সাংবাদিকতার জগতে দিকপালও। কিন্তু একবারের জন্যেও খুজে দেখি না- পত্রিকাটির অরিজিনাল ব্রান্ডভ্যালু কিন্তু মাওলানা ভাসানীর- তখন এটি সাপ্তাহিক ছিলো, ১৯৫৩ থেকে মানিক মিয়ার অধীনে দৈনিক হয়েছে। তথাপিও ভাসানীর জন্ম বা মৃত্যুদিনে ইত্তেফাকের ভেতরের পাতায় এক ইঞ্চির একটি অর্ধেক কলাম হয়তো দেখা যায় ! কারণ, ভাসানী এখন পরাজিতদের দলে তাই।
সুতরাং হতাশ হওয়ার কারণ নেই। ১৩৯ বছর পরে আমরা সিরাজকে ঘৃণা থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম। পরাজিত বীর হিসাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসেও প্রত্যেকের প্রাপ্য স্থান বুঝিয়ে দেওয়া হবে। শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে বীরদের প্রতি যে অসম্মান করা হচ্ছে তার হিসাবও ইতিহাস বুঝিয়ে দিবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।