■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
জ্বালানি সংকটে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কম থাকায় সারাদেশে লোডশেডিং বাড়ছে। সোমবার বিকাল ৩টায় দেশে ১৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াটের চাহিদা ছিল কিন্তু লোডশেডিং হয়েছে ১ হাজার ৮৭৪ মেগাওয়াট।
গত তিন দিন ধরে সারাদেশে লোডশেডিং বাড়ছে। ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে সাধারণ মানুষ। যদিও দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। চাহিদা এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির দাপ্তরিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল ১২ হাজার ৭৮৮ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সন্ধ্যায় চাহিদা বেড়ে ১৫ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে কারণে লোডশেডিং বাড়বে।
গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছেন না বলে জানান বিপিডিবির কর্মকর্তারা।
বিপিডিবি থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় ৪ হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল (সামিটের মালিকানাধীন) তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ, তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সামিট গ্রুপ তাদের এলএনজি টার্মিনালের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে পারছে না। যে কারণে আমদানি করা সরবরাহ থেকে জাতীয় গ্রিড প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস পাচ্ছে না।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৪ হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ২ হাজার ৬০৯ দশমিক ৪ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন হয়েছে।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট।
সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট।
ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা। তাদের বিদ্যুৎ বিল পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ডলারের (প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা) বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা) পরিশোধের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। বকেয়া বিল পরিশোধে চাপ দিচ্ছে তারা। কেন্দ্রটির কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এতে উৎপাদন কমিয়ে এক হাজার মেগাওয়াটে আনা হয়েছে।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কম, বকেয়া বিলের চাপ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। বকেয়া পরিশোধে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
গত কয়েকদিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকার বাসিন্দারা।
অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলোতে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সূত্র বলছে, সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) এই অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
পল্লী বিদ্যুৎ-১-এর সূত্র জানায়, বিদ্যুতের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম থাকায় তারা দিনে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছেন না।
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক মোল্লা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সোমবার দুপুরে আমাদের আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩১৩ মেগাওয়াট, কিন্তু সরবরাহ ছিল মাত্র ১৭০ মেগাওয়াট।’
এ সমিতির আওতায় শিল্প ও আবাসিক মিলিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি গ্রাহক রয়েছেন।
অন্যদিকে, ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মাশফিকুল হাসান বলেন, সোমবার দুপুরে তাদের চাহিদা ছিল ৪২৫ মেগাওয়াট, বিপরীতে সরবরাহ ছিল মাত্র ৩০৬ মেগাওয়াট।
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর আওতায় প্রায় সাত লাখ গ্রাহক রয়েছেন, যার মধ্যে ৬.২৫ লাখই আবাসিক গ্রাহক বলে জানান এ কর্মকর্তা।
পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরেই তারা লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন, আর গত ৩-৪ দিন ধরে এটি চরম মাত্রায় পৌঁছেছে।
সাভারের গেন্ডা এলাকার বাসিন্দা শামীমা আক্তার বলেন, ‘দিনে গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। একদিকে প্রচণ্ড গরম, তার উপর এত লোডশেডিং, বাচ্চাদের লেখাপড়ারও ক্ষতি হচ্ছে।’
‘একবার বিদ্যুৎ গেলে ২ ঘণ্টার আগে ফিরে আসে না, সারাদিনই এমন চলছে,’ যোগ করেন তিনি।
আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার বাসিন্দা শামসুজ্জোহা মিঠু বলেন, ‘দিনে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে, এক ঘণ্টা থাকে না। গড়ে দিনের অর্ধেক সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না, গভীর রাতেও লোডশেডিং হচ্ছে।’
তিনি জানান, গত এক সপ্তাহ ধরেই তারা এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
লোডশেডিং বেশি গ্রামাঞ্চলে
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি হলে লোডশেডিং বেশি করা হয় গ্রামাঞ্চলে। ঘাটতি অনেক বেশি হলে রাজধানী ঢাকায়ও লোডশেডিং করতে হয়। ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গতকাল বিকেল চারটা থেকে ডিপিডিসি ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে। আর সন্ধ্যায় ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে ডেসকো। এর বাইরেও দিনের বিভিন্ন সময় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের খোঁজ পাওয়া গেছে।
ঢাকার বাইরে শহর এলাকায়ও কিছু লোডশেডিং হচ্ছে। তবে বেশি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্র বলছে, গতকাল চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করতে হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় লোডশেডিং ছিল না। আবার কোনো কোনো এলাকায় ৫০ শতাংশের বেশি ঘাটতি ছিল। এতে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় লোডশেডিং করতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চলে।
ময়মনসিংহ থেকে বিভাগের চার জেলা ছাড়াও কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পাওয়ার গ্রিড পিএলসির নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত সাড়ে আটটায় চাহিদা ছিল ১ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে ৯৩২ মেগাওয়াট।
যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অধিকাংশ সময় অলস বসে থাকে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে না, এটা মাথায় রেখেই কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি কী, তা তুলে ধরেন ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩–এর উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) অনিতা বর্ধন। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকার পর, এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
পিডিবির কুমিল্লা অঞ্চল সূত্র জানায়, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী—এই ছয় জেলায় গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। গতকাল সকালে ৮০০ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ হয়েছে। কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২–এর মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সমিতিতে গড়ে ৬৫ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি।’
বিদ্যুৎ নিয়ে গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৪–এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং থাকে মনোহরগঞ্জের দক্ষিণ এলাকায়। আমরা গড়ে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকি। বাকি সময় লোডশেডিং থাকে। বিদ্যুৎ নিয়ে এ এলাকার মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।’
বাড়তি উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে কেন্দ্রভাড়া দিতে গিয়ে সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। তাতেও ওঠেনি উৎপাদন খরচ। তখন দিতে হয়েছে বিপুল ভর্তুকি, যা সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ওপর চাপ ফেলেছে। চাপে পড়েছে অর্থনীতিও।
অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিশোধ করতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ
লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশি হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ পাস করা হয়, যা দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এ আইনের অধীন দরপত্র ছাড়াই নির্মাণ করা হয় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রথমে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্ত হলেও পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিতে থাকেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়।
দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি, উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ গুণ। আর কেন্দ্রভাড়া বেড়েছে ১৬ গুণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এভাবে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময় দেখা গেছে, ৫ হাজার থেকে বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও অর্ধেকের মতো সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে। পরিশোধ করতে হচ্ছে সক্ষমতার ভাড়া, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য (বিদ্যুৎ) মিজানুর রহমান বলেন, ২০২১ সালে চাহিদা হওয়ার কথা ছিল ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বাস্তবেও অনেকটা তাই হয়েছে। ২৫ শতাংশ বাড়তি ধরে উৎপাদনসক্ষমতা হওয়ার কথা ছিল ১৮ হাজার মেগাওয়াট। করা হয়েছে ২২ হাজার মেগাওয়াট (২০২১)।
দরপত্র ছাড়া খেয়াল-খুশির চুক্তি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে এটি করেছে। কেন্দ্রভাড়া দিতে দিতেই দেউলিয়া হওয়ার দশা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সংশোধন বা বাতিল করতে হবে।
বাড়তি উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে কেন্দ্রভাড়া দিতে গিয়ে সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। তাতেও ওঠেনি উৎপাদন খরচ। তখন দিতে হয়েছে বিপুল ভর্তুকি, যা সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ওপর চাপ ফেলেছে। চাপে পড়েছে অর্থনীতিও। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কেন্দ্রভাড়া ছিল ২ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। সবশেষ অর্থবছরের (২০২৩-২৪) হিসাব চূড়ান্ত হলে তা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে জানিয়েছে পিডিবি সূত্র।
দেড় দশক আগে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল গড়ে ২ টাকা ৫৩ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১১ টাকা ৩৩ পয়সা। দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। এরপরও প্রতিবছর সরকারি ভর্তুকি বরাদ্দের ওপর চাপ বাড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা আছে।
বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদনক্ষমতা, খরচ কেন বাড়ল ইত্যাদি নিয়ে গত ২৫ আগস্ট বিদ্যুৎ বিভাগে একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ খাতের দুজন ব্যবসায়ী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। এটি হয়েছে মূলত জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ হয় জ্বালানির দাম বাবদ। সেই জ্বালানির দাম বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ। এটা না হলে বিদ্যুৎ খাতে কোনো ভর্তুকির প্রয়োজন হতো না। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলত না।
দেশজুড়ে ভোগান্তি
কুড়িগ্রামে ঘন ঘন লোডশেডিং চলছে এক সপ্তাহ ধরে। এতে সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। শহরের মজিদা কলেজ মোড়ের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘সকাল থেকে বিদ্যুৎ গেছে চারবার। ছবি তোলা ও প্রিন্টের কাজ করতে পারছি না, ক্রেতারা ঘুরে যাচ্ছে।’ পুরাতন থানাপাড়ার রুমা রানী মোহন্ত বলেন, ‘বিদ্যুৎ খুব ঝামেলা করছে। বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি।’
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী জীবন চন্দ্র রায় জানান, শনিবার জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৮ মেগাওয়াট। আর বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৩৮ মেগাওয়াট। ঘাটতি পূরণে ৮টি ফিডে রুটিন করে লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
বিদ্যুৎ থাকছে না সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে শান্তিগঞ্জের সোহেল তালুকদার জানান, শনিবার রাত ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। পরে কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ পেলেও রাত আড়াইটা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত আবার বিদ্যুৎহীন।
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে মানুষ। দিনের তুলনায় রাতে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। পল্লী বিদ্যুৎ অফিস জানায়, বানিয়াচং উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ মেগাওয়াট। আর পাওয়া যাচ্ছে ৯ থেকে ১০ মেগাওয়াট। উপজেলার নন্দীপাড়ার মহিনুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে।’
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দু’দিন ধরে সরবরাহ মিলছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রংপুর বিভাগের আট জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে চাহিদা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ।
রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সরবরাহ কম থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বগুড়া শহরের রাজাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ঠিকমতো বেচাবিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’ নেসকো সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০৫ মেগাওয়াট। আর জাতীয় গ্রিড থেকে মিলছে ৫০ থেকে ৬০ মেগাওয়াট।
নীলফামারীতে লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানায় উৎপাদন। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা পড়েছেন ক্ষতির মুখে। শুধু তাই নয়, লো-ভোল্টেজে ঝুঁকি নিয়ে মিল-কারখানা চালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক মোটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ঢেলাপীরের কাদিখোল এলাকার ইকু জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুল আলম জানান, তাঁর কারখানা থেকে পণ্য রপ্তানি হয় ভারত, নেপাল, ভুটারসহ বিভিন্ন দেশে। দেড় মাস ধরে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
গাইবান্ধার পাঁচ উপজেলার অনেক এলাকায় রাতে দুই-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন গ্রাহকরা। পৌর এলাকার গৃহিণী সিদ্দিকা কামাল নাজু বলেন, ‘লোডশেডিংয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। গরমের কারণে রাতে ঘুমাতেও পারি না।’ শহরের ব্রিজরোড এলাকার ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী তৈয়ব মিয়া বলেন, ‘বিদ্যুতের ওপরই আমাদের ব্যবসা। বিদ্যুৎ ঠিকমতো না পাওয়ায় ব্যবসা করতে পারছি না।’ নেসকো গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান জানান, চাহিদার তুলনায় তিনিও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন কম। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র
মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিন হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। জ্বালানি সংকটে দেশে ছয় হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। বিদ্যুতে প্রতিদিন গড়ে ৮৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, যা এপ্রিলে ছিল ১৩৫ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। পেট্রোবাংলা প্রতিদিন সরবরাহ করছে ২৫৯ ঘনফুট গ্যাস।
জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমেছে। ত্রিপুরা থেকে ঘণ্টায় ১৬০ মেগাওয়াটের স্থানে ৬০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও মিলছে ৮৮০ মেগাওয়াট। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও ৪০০ মেগাওয়াট কম আসছে।
বকেয়া অর্থ আদায়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে আদানি
বিদ্যুৎ বিক্রয় বাবদ বকেয়া অর্থ আদায়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে ভারতের ধনকুবের গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ। গ্রুপের কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশের কাছে তাদের পাওনা বর্তমানে প্রায় ৫০ কোটি ডলার।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে আদানি গ্রুপের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। (দেশটির) নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি এবং বকেয়া পরিশোধ সংক্রান্ত আলোচনার পাশাপাশি সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখা নিয়েও আমাদের কথাবার্তা হচ্ছে।
বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনব্যবস্থা এখনো সচল হয়নি
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনব্যবস্থা এখনো সচল হয়নি। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পুরোপুরিভাবে বন্ধ আছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তিনটি ইউনিটের উৎপাদন। গতকাল সোমবার সকাল নয়টার দিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তৃতীয় ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে থেকেই অন্য দুই ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অয়েল পাম্প (টারবাইন জেনারেল) নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিটটি ফের বন্ধ হয়ে যায়। এর মাত্র চার দিন আগে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই ইউনিটের উৎপাদন শুরু হয়েছিল। এ ইউনিট চালু রাখতে দৈনিক প্রায় ২ হাজার ৩০০ টন কয়লা প্রয়োজন হয়। ইউনিটটি দীর্ঘ ৩৬ দিন পর ৬ সেপ্টেম্বর যান্ত্রিক সমস্যা সমাধান করে উৎপাদন শুরু হয়েছিল।
সেই সঙ্গে ওই দিন রাত পৌনে নয়টায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১ নম্বর ইউনিট সংস্কারকাজের জন্য এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১ নম্বর ইউনিট ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার হলেও উৎপাদিত হতো মাত্র ৬০-৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর ২ নম্বর ইউনিটটি ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার হলেও ৬৫-৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো।
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটির তিনটি ইউনিট উৎপাদনের জন্য দৈনিক প্রায় ৫ হাজার ২০০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কোল ইয়ার্ডে প্রায় ২ লাখ টন কয়লা মজুত আছে। তিনটি ইউনিট একসঙ্গে কখনই চালানো হয়নি। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সরবরাহ করা কয়লার ওপর নির্ভর করে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এই প্রথম বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটির তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়েছে। ফলে পার্বতীপুর উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের আট জেলা ব্যাপকভাবে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে।
১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৬ সালে চীনা কারিগরি সহায়তায় দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির পাশে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। প্রত্যাশা ছিল এর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মিটবে। সেই সঙ্গে শিল্পকলকারখানা ও কৃষি খাতে বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে উন্নীত হবে।