■ ঢাবি প্রতিনিধি ■
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৮ শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, হল প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে ৮ শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় তদন্ত কমিটির চিহ্নিত আট অভিযুক্তের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযুক্ত এই আটজনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সচেষ্ট রয়েছে ও সবার সহযোগিতা কামনা করছে।
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আটজন হলেন- পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মো. মোত্তাকিন সাকিন শাহ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের মো. জালাল মিয়া, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের সুমন মিয়া, ভূগোল ও পরিবেশের ২০২০-২১ বর্ষের ছাত্র আল হোসাইন সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের মো. আহসান উল্লাহ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ বর্ষের মো. ফিরোজ কবির, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ বর্ষের মো. আবদুস সামাদ, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের ওয়াজিবুল আলম।
এদের মধ্যে আল হোসাইন সাজাদ হল ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক, মো. জালাল মিয়া উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক, আহসান উল্লাহ গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপসম্পাদক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন ১৫ থেকে ২০ জন
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেন শুক্রবার বিকেল থেকে ছয় শিক্ষার্থীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে রাত ৯টার দিকে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্টসূত্র গুলো বলছে, ছয় শিক্ষার্থীর জবানবন্দি অনুযায়ী তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন ১৫ থেকে ২০ জন। তাঁরা সবার নাম প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, চোর সন্দেহে তিন দফায় তোফাজ্জলকে মারধর করা হয়।
আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া ছয় শিক্ষার্থী হলেন, মো. জালাল মিয়া, সুমন মিয়া, মো. মোত্তাকিন সাকিন, আল হুসাইন সাজ্জাদ, আহসানউল্লাহ ও ওয়াজিবুল আলম। এরা সবাই ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ছয় শিক্ষার্থীর সবাই বলেছেন, ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে ছাত্রদের ছয়টি মুঠোফোন ও মানিব্যাগ চুরি হয়েছিল। তোফাজ্জল সেদিন রাত আটটার দিকে হলের ফটক দিয়ে মাঠের ভেতরে যান। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী চোর সন্দেহে তাঁকে আটক করে হলের অতিথিকক্ষে নিয়ে যান। পরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁকে স্টাম্প দিয়ে মারধর করা হয়। এরপর তাঁকে হলের ক্যানটিনে নিয়ে রাতের খাবার খাওয়ানো হয়। খাওয়া শেষে আবার তাঁকে হলের অতিথিকক্ষে এনে ব্যাপক মারধর করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
তিন ধাপে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী তোফাজ্জলকে মারধরে জড়িত। জবানবন্দিতে ওই ছয় শিক্ষার্থী তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার নাম প্রকাশ করেছেন। আসামিরা বলেন, সেদিন অতিথিকক্ষে মারধরের পর রাত ১২টার দিকে হলের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষক তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাঁরা জানতে পারেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় তোফাজ্জল মারা গেছেন।
৮ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত
তোফাজ্জলকে হত্যার ঘটনায় ৮ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শুক্রবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় দায়ে ৮ শিক্ষার্থীর হলের সিট বাতিল করে হল প্রভোষ্ট চিঠি দিয়েছেন। এ ছাড়া তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামীকাল আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কারের বিষয়টি জানানো হবে। তবে বহিষ্কার হওয়া ওই ৮ শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় তিনি জানাননি।
তোফাজ্জলের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জলের জানাজা শেষে বরগুনার পাথরঘাটায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। মা-বাবা আর ভাইয়ের কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি।
শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টায় স্থানীয় মাদ্রাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় শোকে কাতর এলাকাবাসী এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।
স্থানীয়রা বলেন, তোফাজ্জল খুবই হাস্যরসিক লোক ছিল। তাকে আমরা কখনই কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। আমরা এই মৃত্যুকে কোনোভাবেই মানতে পারছি না। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ একটা বিদ্যাপীঠে এমন নৃশংস একটা ঘটনা ঘটবে ভাবতেও পারিনি। ও যদিও চুরি করে না তবুও যদি করেও থাকত এ জন্য আইন রয়েছে। সামান্য কয়েক টাকার মোবাইলের জন্য একটা জীবনকে এভাবে চলে যেতে হবে তা মানা যায় না।
জানাজায় অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, রাতে ঘুমাতে পারিনি, শুধু চোখের সামনে ভাত খাবার দৃশ্য ভেসে উঠে। তোফাজ্জল আমার কোনো নিকট আত্মীয় নয় তবুও ওর জন্য মায়া লাগে। এ রকম একটা কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে তা ভাবা যায় না।
তোফাজ্জলের স্কুলশিক্ষক মিলন মিয়া জানান, স্কুল জীবন থেকেই তোফাজ্জল খুব মেধাবী এবং শান্ত স্বভাবের ছিল। ও সবসময় শিক্ষক এবং বড়দের সম্মান করত। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই এবং তার সঙ্গে যারা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন করেছেন তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।