অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

রয়টার্স

শ্রীলঙ্কার প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) শপথ নিয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। শপথ নিয়ে রাজনীতিকদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছেন তিনি। দেশে গণতন্ত্র সুরক্ষা ও সংহত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

সরকার পরিচালনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে (Anura Kumara Dissanayake)। অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে টেনে তুলতে হলে তিনি যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন, তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

অর্থনীতি

২০২২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মারাত্মক ঘাটতি শ্রীলংকার অর্থনীতিকে চরম সংকটে ফেলে। দেশটির মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল ৭০ শতাংশে। যদিও সেই সংকট অনেকটা কাটিয়ে ০.৫ শতাংশে নেমে এসেছিল, তবে এখনো অনেক কিছু করা বাকি রয়েছে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকেকে অর্থনীতির টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির দিকে ফিরে আসা নিশ্চিত করতে হবে।

রিজার্ভ সংকটে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছিল। অবশ্য চলতি বছর তা কমে দশমিক ৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। কিন্তু ২০২২ সালে দেশটির অর্থনীতির আকার কমেছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। গত বছর সেই হার অবশ্য কমে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে।

পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার মিলিয়ে ভারসাম্য আনতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির এক চতুর্থাংশ জনগণকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে।

অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির পথে ফেরানোই হবে অনূঢ়া কুমারার প্রধান চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা ফেরাতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে দেশটির দুই কোটির বেশি দরিদ্র্য মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

বৈদেশিক ঋণ

গত বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পায় শ্রীলঙ্কা। এই ঋণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন বেড়েছে, তেমনি মুদ্রার মান কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা গেছে। এদিকে ঋণ পুনর্গঠন নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

গত জুনে চীনসহ অন্য ঋণদাতা দেশগুলোর সঙ্গে এক হাজার কোটি ডলারের ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে চুক্তি করেছে কলম্বো। এ ছাড়া গত সপ্তাহে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক বন্ড পুনর্গঠন নিয়েও একটি খসড়া চুক্তি হয়েছে। আইএমএফের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে হলে ঋণ পুনর্গঠন করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক ঋণের যে বিশাল বোঝা, তা কমানোর দায়িত্ব থাকবে নতুন প্রেসিডেন্টের।

করের বোঝা

আইএমএফের ঋণের কারণে কর বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপের কারণে দেশটির অনেক মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এই করের বোঝা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অনূঢ়া। কিন্তু তাঁর জন্য কাজটা হবে খুব কঠিন। কেননা, শ্রীলঙ্কার ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে মাত্র তিনটি আসন আছে অনূঢ়ার দলের। এই পার্লামেন্টের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে হবে তাঁকে।

অনূঢ়া কুমারা অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শপথ নেওয়ার দেড় মাসের মধ্যে পার্লামেন্টে বিলুপ্ত করে আগাম সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন। নতুন পার্লামেন্টের ওপর নির্ভর করবে তাঁর সরকার নীতি প্রণয়নে কতটা সফল হবে।

অনূঢ়া কুমারা জানিয়েছেন, ঋণ ও এর শর্ত পুনরায় বিবেচনার জন্য আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি। পাশাপাশি কর কমানোর বিষয়টি নিয়েও কথা বলবেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্যসামগ্রীর মতো কিছু বিষয়ে মূল্য সংযোজন কর কমাবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

জুন মাসে কলম্বো, চীন এবং অন্যান্য ঋণদাতা দেশগুলোর সঙ্গে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক ঋণ পুনর্গঠন করার জন্য চুক্তি করেছে শ্রীলংকা। গত সপ্তাহে ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বন্ড পুনর্গঠনের জন্য একটি খসড়া চুক্তিতে পৌঁছেছে দেশটি। ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপি প্রাথমিক ভারসাম্য লক্ষ্যমাত্রার ২.৩% পৌঁছানোর জন্য ঋণ পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে দিশানায়েকে বন্ডহোল্ডার চুক্তিতে পরিবর্তন চাইতে পারেন।

জনকল্যাণ

ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোকে আরও লাভজনক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অনূঢ়া কুমারা। জানিয়েছেন, শিক্ষা খাতে নতুন করে ২০ হাজার চাকরির ব্যবস্থা করবেন। পাশাপাশি পর্যটনের মতো দেশটির অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোতে আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। একই সঙ্গে জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন সরকারি সেবার আওতা ও পরিমাণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

অর্থায়নে ভুল পদক্ষেপ, লোকসানে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের সংকটের কারণে অনূঢ়া কুমারা শিগগিরই এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না বলে মত অর্থনীতিবিদদের।

ভূরাজনীতি

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভূরাজনীতি। বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাপে থাকতে হবে তাঁকে। কারণ, শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া দেশ দুটি হলো ভারত ও চীন। এ ছাড়া ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটির ওপর দুই দেশই প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তাই প্রতিবেশী এই দুই দেশের সঙ্গেই ভারসাম্যের নীতিতে চলতে হবে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টকে।

শ্রীলঙ্কার যে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে, তার বেশির ভাগই জাপান, ভারত ও চীনের দেওয়া। অনূঢ়া কুমারা অবশ্য জানিয়েছেন, এসব দেশের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক অব্যাহত রেখে প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক মিত্রতার সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চান তিনি।

রোববার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকলেও দিশানায়েকে ভোট পেয়েছিলেন ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসজেবির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা পান ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে কোনো প্রার্থীকে পেতে হবে মোট ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি। ফলে ভোট গণনা গড়ায় দ্বিতীয় দফায়। শ্রীলংকার নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি ব্যালট পেপারে ভোটাররা পছন্দ অনুসারে পর্যায়ক্রমে তিনজন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। সেই নিয়ম মেনে এগিয়ে থাকা দুই প্রার্থীকে ‘দ্বিতীয় পছন্দের’ প্রার্থী হিসাবে যারা ভোট দিয়েছিলেন সেগুলো আবার গণনা করা হয়। পরের রান-অফ ভোটেও বাজিমাত করেন তিনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে দিশানায়েকেকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির অভিনন্দনের জবাবে শ্রীলংকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি, আপনার সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। দুই দেশের সহযোগিতা আরও জোরদার করার জন্য আপনার যে প্রতিশ্রুতি, তার পাশে রয়েছি। দুই দেশ এবং সমগ্র অঞ্চলের নাগরিকদের স্বার্থে আমাদের এই সহযোগিতা।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *