■ রয়টার্স ■
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ হওয়া উচিত। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রয়টার্সে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই কথা বলেন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর কার্যালয়ে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যে কোনো মূল্যে’ পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছিল।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘যাই হোক না কেন’ সরকারকে সমর্থন করে যাব। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না জানিয়েছেন তিনি।
রয়টার্স বলছে, গত আগস্টের শুরুতে হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং সেনাবাহিনী কোনো বাধা দেয়নি। আর এতেই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় এবং ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর স্বৈরাচারী এই শাসক পদত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমি তার (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) পাশে থাকব। যাই হোক না কেন। যাতে তিনি তার মিশন সম্পন্ন করতে পারেন। তিনি (ড. ইউনূস) ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করতে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংস্কারের পর গণতন্ত্রে উত্তরণ এক বছর থেকে দেড় বছরের মধ্যে করা উচিত। তবে এই সময়ে ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। বলেন, “আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি বলব— এ সময়সীমার মধ্যেই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত।”
জেনারেল ওয়াকার বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং তিনি (সেনাপ্রধান) প্রতি সপ্তাহে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অশান্তির পর দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে— আমরা যদি এক সঙ্গে কাজ করি তবে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, আমি এমন কিছু করব না যা আমার সংস্থার (সেনাবাহিনী) জন্য ক্ষতিকর হয়। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার সেনাবাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই।”
হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার পর থেকে প্রস্তাবিত ব্যাপক সরকারি সংস্কারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তার সদস্যদের ইতোপূর্বে করা অন্যায়ের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে এবং এরই মধ্যে কিছু সৈন্যকে শাস্তিও দিয়েছে। তবে এই বিষয়ে আরো বিশদ কোনও বিবরণ দেননি জেনারেল ওয়াকার।
বাংলাদেশ সেনাপ্রধান বলেন, “যদি (সেনাবাহিনীর) কোনো কর্মরত সদস্য দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব। কিছু সামরিক কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী (হাসিনা) বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোতে কাজ করার সময় অন্যায় কাজ করতে পারেন।”
দীর্ঘ মেয়াদে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখার ইচ্ছার কথাও জানান সেনাপ্রধান। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি কেবল তখনই ঘটতে পারে যখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকবে। সেক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।’
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলান। অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এ দিকটায় নজর দিতে পারে বলেও উল্লেখ করেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। কোনো অবস্থাতেই একজন সৈনিকের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত নয়।’
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও তাঁর বাহিনী আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ থামাতে ব্যবস্থা নেয়নি। এটি শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে পদত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত চলে যেতে বাধ্য হন তিনি।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের অগ্রদূত ড. ইউনূস বিচার বিভাগ, পুলিশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে ১৭ কোটি মানুষের দেশটিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, পরে এটি সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। এ সময় ১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজধানী ঢাকার জমজমাট রাস্তায় শান্তি ফিরে এলেও হাসিনা সরকারের নাটকীয় পতনের পর প্রশাসনের কিছু অংশ এখনো সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশের পুলিশের বড় একটি অংশ এখনো বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তাই সেনাবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনী এখনো বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে এগিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশটি সামরিক শাসনের অধীনে আসে। ১৯৯০ সালে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়। ২০০৭ সালে আবার বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান হয়। তাদের সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘যদি কোনো দায়িত্বরত সদস্য দোষী প্রমাণিত হন, অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব।’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোতে থাকায় কিছু সামরিক কর্মকর্তা আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করে থাকতে পারেন বলেও জানান তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গুম হতে পারে এমন প্রায় ৬০০ জনের বিষয়ে তদন্তের জন্য হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে।
যা-ই ঘটুক, তাঁর বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে চান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সৈন্য রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি সেনা পাঠানো দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।