সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং

■ সাহিত্য ডেস্ক ■

চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্যে ঐতিহাসিক ক্ষত তুলে ধরার জন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) বিকেল ৫টার দিকে পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে সুইডিশ অ্যাকাডেমি।

এ পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার পাবেন হান কাং (Han Kang)। গত বছর এ সম্মাননা পেয়েছিলেন নরওয়ের লেখক, নাট্যকার ও কবি ইয়োন ফোসে।

নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে পুরস্কার দিয়ে আসছে। হান কাংকে নিয়ে ১৮তম বারের মতো একজন নারী পুরস্কারটি পেলেন।

প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান হিসেবেও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং। নোবেল পুরস্কার বোর্ড তাঁর পরিচিতি দিতে গিয়ে বলেছে, তিনি এমন একজন যিনি সঙ্গীত ও শিল্পকলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

দক্ষিণ কোরীয় সাময়িকীতে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে লেখক হিসেবে হান কাংয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯৫ সালে ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর গদ্য পাঠকের সামনে আসে।

দক্ষিণ কোরিয়ান এই লেখিকার সবচেয়ে আলোচিত সাহিত্যকর্ম হলো (দ্য ভেজেটেরিয়ান-The Vegetarian)। এটি তিন খণ্ডে লেখা হয়েছে। এটিতে এক নারীর গল্প তুলে আনা হয়েছে। যিনি মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানানো পর কীভাবে তার স্বামী, বাবা এবং অন্যান্যদের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।

২০০৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্য ২০১৬ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এ উপন্যাসে হান কাং মানুষের নিষ্ঠুরতায় আতঙ্কিত এক তরুণীর ‘বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন। এই উপন্যাসে তিনি মানুষের নিষ্ঠুরতা নিয়ে আতঙ্কে ভুগতে থাকা এক তরুণীর ‘বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার চেষ্টার কথা তুলে ধরেন।

৫৩ বছর বয়সী হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজুতে জন্ম নেন। সাহিত্য চর্চার পরিবেশেই তিনি জন্ম নেন। তাঁর বাবা ছিলেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক।

নোবেল কমিটি বলেছে, ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন হান কাং। যখন পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের বাসিন্দা। ৫৩ বছর বয়সী কোরিয়ান ভাষার এ লেখককে মনোনীত করার কারণ হিসেবে তারা বলেছে, গভীর কাব্যিক গদ্যের জন্য হানকে এ বছরের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। তার লেখায় যন্ত্রণাদায়ক বিষয়াবলি রূপায়িত হয় এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে।

১৯৯৫ সালে ছোট গল্প সংকলন লাভ অফ ইয়েসু দিয়ে তার গদ্য আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেসব গদ্য পাঠক মহলে প্রশংসিত হলে তিনি অনুপ্রাণিত হন। এরপর তিনি দীর্ঘাকার গদ্য লেখায় মনোনিবেশ করেন।

হান কাংয়ের জন্ম গোয়াংজুতে হলেও তার বেড়ে উঠা সিউলে। তার ৯ বছর বয়সে মা-বাবা পরিবার নিয়ে সিউলে চলে আসেন এবং সেখানে বসবাস করতে থাকেন। সাহিত্যিক পরিবারে জন্ম হানের লেখালেখির ওস্তাদ তার বাবা। বাবা হান সিউং-ওন একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। বাবার কাছ থেকেই তিনি লেখার রসদ পেয়েছেন।

কোরিয়ায় প্রকাশিত তার রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্রুটস অফ মাই ওম্যান (২০০০) এবং ফায়ার স্যালাম্যান্ডার (২০১২); দ্য ব্ল্যাক ডিয়ার (১৯৯৮), ইয়োর কোল্ড হ্যান্ডস (২০০২), দ্য ভেজিটেরিয়ান (২০০৭), ব্রেথ ফাইটিং (২০১০), গ্রিক লেসনস (২০১১), হিউম্যান অ্যাক্টস (২০১৪), দ্য হোয়াইট বুক (২০১৬), এবং উই ডোন্ট পার্ট (২০২১); কবিতার বই আই পুট দ্য ইভনিং ইন দ্য ড্রয়ার (২০১০); প্রবন্ধ ‘লাভ অ্যান্ড দ্য থিংস অ্যারাউন্ড দ্য লাভ (২০০৩), কুয়াইটলি সাং সং (২০০৭)।

লেখালেখির পাশাপাশি হান কাং একজন সংগীতশিল্পী; এছাড়া ভিজ্যুয়াল আর্টেও রয়েছে তার আগ্রহ। ‘ইউর কোল্ড হ্যান্ড (২০০২)’ একজন ভাস্কর ও তার মডেলের গল্প ঘিরে আবর্তিত হয়। তিনি দশটি গানসহ একটি সিডি প্রকাশ করেছিলেন, এর জন্য গানের কথা লিখেছিলেন এবং রেকর্ড করেছিলেন। প্রথমে তিনি গান গাওয়ার ইচ্ছা করেননি, তবে হান জং রিম নামে একজন সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালকের জোরাজুরিতে তিনি কণ্ঠ দেন।

১৯৯৯ সালে তার উপন্যাস ‘বেবি বুদ্ধ’র জন্য ২৫তম কোরিয়ান উপন্যাস পুরস্কার, ২০০০ সালে ‘টুডেজ ইয়ং আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’, ২০০৫ সালে মঙ্গোলিয়ান মার্কের সাথে ‘ই সাং সাহিত্য’ পুরস্কার এবং ২০১০ সালে ‘ডং-ইন সাহিত্য পুরস্কার’ জিতেন।

‘বেবি বুদ্ধ’ ও ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা। ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’কে এমন একটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছিল যা মর্যাদাপূর্ণ উত্তর আমেরিকান ফিল্ম ফেস্টের ওয়ার্ল্ড ন্যারেটিভ প্রতিযোগিতায় ও বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সাফল্য অর্জন করে।

২০১৭ সালে তিনি রচনা করেন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বুক’। এটি তার বড় বোনকে হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যিনি তার জন্মের দুই ঘণ্টা পর মারা যান। ২০১৮ সালে ক্যাং ফিউচার লাইব্রেরি প্রকল্পে অবদান রাখার জন্য নির্বাচিত পঞ্চম লেখক হয়েছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি তার চতুর্থ পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ প্রকাশ করেছিলেন। আটলান্টিক এটিকে এমন একটি বই বলে অভিহিত করেছে, ‘যার শব্দগুলো অপর্যাপ্ত তবে সম্মোহিত করতে খুবই শক্তিশালী।’

তিনি ২০২৩ সালে রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার আন্তর্জাতিক লেখক হিসেবে নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সুইডিশ একাডেমি তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। তারপর থেকে তিনি ই সাং সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫), আজকের তরুণ শিল্পী পুরস্কার এবং কোরিয়ান সাহিত্য উপন্যাস পুরস্কার জিতেছেন। ক্যাং সিউল ইনস্টিটিউট অফ আর্টসে সৃজনশীল লেখালেখি শিখিয়েছেন এবং বর্তমানে তার ষষ্ঠ উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন। 

বুধবার (৯ অক্টোবর)  রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান ডেভিড বেকার, ডেমিস হাসাবিস এবং জন জাম্পার। এদের মধ্যে ডেভিড বেকার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, ডেমিস হাসাবিস এবং জন জাম্পার যুক্তরাজ্যের নাগরিক।

মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) পদার্থবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান মার্কিন বিজ্ঞানী জন জে হোপফিল্ড এবং কানাডার বিজ্ঞানী জিওফ্রে ই হিন্টন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মেশিন লার্নিং বিষয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাদের এ অর্জন।

সোমবার (৭ অক্টোবর) চিকিৎসাশাস্ত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পান ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন। মাইক্রোআরএনএর কার্যক্রম আবিষ্কারের জন্য এই পুরস্কার পান তারা।

প্রতি অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার থেকে শুরু হয় নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করা হল। নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, আজ ৮ অক্টোবর পদার্থবিদ্যা, ৯ অক্টোবর রসায়ন, ১০ অক্টোবর সাহিত্য, ১১ অক্টোবর সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরস্কার শান্তিতে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। এছাড়া ১৪ অক্টোবর অর্থনীতিতে বিজয়ীর নাম ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা।

প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি- এই ছয় বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন; তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কার প্রদানের পর তা উদযাপনে উৎসবের আয়োজন করে নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির সদর দফতর নরওয়েতে।

উনবিংশ শতাব্দিতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাজারে যা প্রায় ১৮০ কোটি ক্রোনের সমান। আলফ্রেড নোবেলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার শুরু হয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। প্রথম দিন ঘোষণা করা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল।

ছয়টি বিভাগে ছয় দিন নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা হয় নরওয়ে থেকে। সাহিত্য ও অর্থনীতির মতো অন্য পুরস্কারগুলো সুইডেন থেকে ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।

১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১১৪টি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। ২২৭ জন বিজয়ীর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নারী।

শুরুতে নোবেল বিজয়ীদের প্রায় দেড় লাখ ক্রোনা দেওয়া হতো। বাড়তে বাড়তে ১৯৮১ সালে তা ১০ লাখ ক্রোনা হয়। এরপর পুরস্কারের আর্থিক মূল্য দ্রুত বাড়ানো হয়। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এর পরিমাণ ১ কোটি ক্রোনা হয়।

সর্বশেষ এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাড়ানো হয় নোবেল পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী। এ বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা মোট ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা (৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলার) পাবেন, যা আগের চেয়ে ১০ লাখ ক্রোনা বেশি। নোবেল ফাউন্ডেশনের তহবিলের উন্নতি হওয়ায় এ বছর পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ফাউন্ডেশনের তহবিলে টান পড়ায় ২০১২ সালে পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি ক্রোনা থেকে কমিয়ে ৯০ লাখ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে ৯০ লাখ এবং ২০২০ সালে ফের এক কোটিতে উন্নীত করা হয়।

গত এক দশকে ইউরোর বিপরীতে প্রায় ৩০ শতাংশ দর হারিয়েছে সুইডিশ ক্রোনা। ফলে পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ ক্রোনা বাড়ানো হলেও সুইডেনের বাইরে তা ততটা বাড়বে না।

২০১৩ সালে আর্থিক সম্মানী কমিয়ে ৮০ লাখ ক্রোনা করা হয়। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় এই পুরস্কারের পরিমাণ দাঁড়াত ১২ লাখ ডলার। সেটা বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনা হলেও বিনিময় হারের খেলায় ২০২৪ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ডলারের কম। মুদ্রাস্ফিতি বিবেচনায় নিলে নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান খুব একটা বাড়েনি।

বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার মূল্যমান দাঁড়ায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *