■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড় ডানায় পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের সব সমুদ্র বন্দরে দুই নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করা গভীর নিম্নচাপটি উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে সোজা অগ্রসর হচ্ছে। এর প্রভাবে উপকূলে হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকালে আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুর রহমান খানের সই করা ৭২ ঘণ্টার জন্য দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে অবস্থান করছিল। এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
যে কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে দুই নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে, যেন স্বল্প সময়ের নোটিশে নিরাপদ আশ্রয় যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে আগামী তিন দিন ভারি বৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, ঝড়টি একটু ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। আগে আমরা উড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ মধ্যবর্তী এলাকার উপর দিয়ে যাবে বলে ধারণা করেছিলাম। এখন ডান দিকে বাঁক নেওয়ায়-তা পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে উপকূলে আঘাত করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে ঝড়টি কোন দিকে যাবে? কিংবা আদৌ তা ঝড়ে রূপ নেবে কিনা জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সাদেকুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি যেহেতু ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে তাই এটি বৃহস্পতিবার বিকেলের পর বা রাতে গিয়ে হয়তো উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন হলো উপরিভাগের বাতাসের গতিবেগ। ঘূর্ণিঝড়ের দিক মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সেই বাতাস। এখন পর্যন্ত উপরের বাতাস বাংলাদেশ উপকূলের অনুকূলে, অর্থাৎ আমাদের দেশে আসার কোনো সুযোগ নেই। ঝড়টি উড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূল দিয়ে অতিক্রম করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, প্রায় ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের এই ঝড়টির প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এই দুই দিন বৃষ্টি হতে পারে।
বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারি বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় দিনের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমলেও রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পাবে।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। কোথাও কোথাও ভারি বর্ষণও হতে পারে। এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমবে। শেষ ২৪ ঘণ্টার (শুক্রবার) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সে সঙ্গে কোথাও কোথাও ভারি বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ সময় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমার পাশাপাশি দিনের তাপমাত্রা বাড়তে পারে।
সিনপটিক অবস্থায় বলা হয়েছে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপ এবং পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’য় পরিণত হয়ে পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় (১৬.২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০.০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) আজ সকাল ৬টায় অবস্থান করছে। এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ নামকরণ যেভাবে
ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করেছে কাতার। এই ‘ডানা’ নামের অর্থ মুক্ত বা স্বাধীনতা। তবে এই ঘূর্ণিঝড় কোথা দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করবে অথবা কোথায় এটির ল্যান্ডফল হবে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।
সাগরে নিম্নচাপের সময় বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত বায়ুমণ্ডলীয় উত্তাল অবস্থাকে সংক্ষেপে ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। বাতাসের এই একটানা ঘূর্ণায়মান গতি যখন একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছায়, তখনই এর নামকরণ করা হয়। আটলান্টিক মহাসাগর ও এর আশপাশের অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটারে উঠে গেলে নিম্নচাপ ঝড়ে পরিণত হয়। আর এ সময়ই ঘূর্ণিঝড়টিকে একটি নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
Q, U, X, Y ও Z- এই ৫টি অক্ষর বাদ দিয়ে ইংরেজি বর্ণমালার ২১টি অক্ষর ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়। এগুলো সাধারণত এক বছরের জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে করা হয়। তবে কোনো বছর যদি ২১টির বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়, তবে নামগুলোর সঙ্গে গ্রিক বর্ণমালা যুক্ত করা হয়। নামকরণের পদ্ধতি অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা আঞ্চলিক কমিটির অধীনে মোট ৫টি আঞ্চলিক সংস্থা তাদের স্ব স্ব অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করে। এগুলো হলো- ইএসসিএপি (ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক) বা ডব্লিউএমও (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা) টাইফুন কমিটি, ডব্লিউএমও বা ইএসসিএপি প্যানেল অন ট্রপিক্যাল সাইক্লোন, আরএ (রেজিওনাল অ্যাসোসিয়েশন) ট্রপিক্যাল সাইক্লোন কমিটি, আরএ-৪ হারিকেন কমিটি, আরএ-৫ ট্রপিক্যাল সাইক্লোন কমিটি।
ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর নামকরণ করে ১৩টি দেশ। সেগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ওমান, ইরান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার।
ডব্লিউএমওর অংশ হিসেবে উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করে থাকে- আরএসএমসি, ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ওয়ার্নিং সিস্টেমস (টিসিডব্লিউএস) ও ভারতের আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি)।