:: ফারহান আরিফ ::
পূর্ব প্রকাশের পর
ইমরান খানের পায়ের তলায় ভীত এনে দেয় ২০১৩ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে তার দল খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। তবে নির্বাচনের পরপরই তিনি অন্যান্য প্রদেশে কারচুপির অভিযোগ এনে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে এসে ইসলামাবাদ অভিমুখে লং মার্চ শুরু করেন ইমরান খান; এবং এখানে এসে প্রায় চার মাস হাজার হাজার নেতাকর্মী সহ তিনি অবস্থান কর্মসূচী পালন করেন। এতে নওয়াজ শরিফের সরকারের পতন না হলেও ভীত নড়ে যায়। দেরিতে হলেও একপর্যায়ে নওয়াজ শরীফ ক্ষমতাচ্যুত হন। তার জায়গা নেন শহীদ খাক্বান আব্বাসি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দুর্নীতিগ্রস্থ সাব্যস্ত হয়ে নওয়াজ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও এর পেছনে ডিপ স্টেইটের কলকাঠি ছিল বলে ধারণা করা হয়। বলা হয়, মূলতঃ তালেবান প্রশ্নের কোনো সুরাহা না করতে পেরে পাকিস্তান আর্মি বেশ বেকায়দায় ছিল। পারভেজ মোশাররফ সরকারের আমলে প্রথমদিকে ন্যাটো বাহিনীর সাথে ওয়ার অন টেররে সহযোগিতা চুক্তিতে গেলেও একপর্যায়ে সরে এসেছে। ফলে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে।
ইমরানের খানের রাজনীতিতে কোনো ক্ল্যাসিকাল বেসিস ছিল না কখনোই। তত্ত্বীয় রাজনীতির বাইরে এসে পপুলিস্ট রাজনীতির মাধ্যমে তার উত্থান। তবে ইমরান খানের পপুলিস্ট ধারার রাজনীতির শুদ্ধাচারটি হচ্ছে, তিনি পপুলিজম উইথ একটিভিজমের বদলে পপুলিজম উইথ মেনিফেস্টো গ্রহণ করেছিলেন। ফলে মমতা ব্যানার্জি এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো তার টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অবশ্য এখনই বলা ঠিক হবে না যে, তিনি টিকবেন না। আপাতত বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি থাকলেও ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো সামাল দিতে পারলে তিনি ফিরেও আসতে পারেন। সেই ফাইনালে নিজে ১১০ বলে ৭২ রানের পাশাপাশি ওয়াসিম আকরামকে দিয়ে তার সেরাটা বের করে এনেছিলেন। ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন খানের সেই সার্থকতা কি রাজনীতির মাঠে সমানভাবে কথা বলবে? সেটা আপাতত সময়ের হাতে তুলে দিয়ে নজর দেয়া যাক, ইমরান খানের সাড়ে তিন বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বের ক্যারিয়ারে।
২০১৮ সালের ১৮ই আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইমরান খান জবাবদিহিতার প্রশ্নে তা নিজের থেকেই শুরু হবে বলে ঘোষণা দেন। তার শাসনামলে বেশ কিছু কার্যক্রম প্রশংসার দাবী রাখে। যেমন- পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ইমরান ২০১৪ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় যে বিলিয়ন ট্রি প্রজেক্ট গ্রহণ করেছিলেন সেটি দেশব্যপী সম্প্রসারণ করেন। তাছাড়া কোভিড মহামারিকালে ইমরান খানের সরকার দীর্ঘমেয়াদি লক ডাউন প্রক্রিয়ায় যায় নি। বরং ধীরে ধীরে সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। এর ফলে একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইমরানের পাকিস্তান উতরে যেতে সক্ষম হয়।
ইমরানের একটা বড় সফলতা ছিল, রেডিমেইড গার্মেন্টসের বাজার সৃষ্টি। বাংলাদেশ যেখানে এই খাতে বাজার হারাচ্ছে, পাকিস্তান ঠিক সেই সময়েই এই সেক্টরে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। তাছাড়া পাকিস্তানের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে নাগরিকের জন্য হেলথ কার্ড প্রণয়ন করে ইমরান খান বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
কিন্তু ইমরান খান সরকার পাকিস্তানের অর্থনীতিকে প্রতিশ্রুত জায়গায় নিয়ে যেতে ব্যর্থই হয়েছে। তার শাসনামলে মূল্যস্ফীতি ২৩ শতাংশে বেড়েছে। তাছাড়া বিরোধী দলসমূহের উপর ইমরানের সরকার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি খড়গহস্ত ছিল বলে দাবী করা হয়। বিরোধীদের বক্তব্য সম্প্রচারে সীমাতিরোপ করা হয়, যেটা ইমরান খানের জন্য পাকিস্তানের হট সীটে বসে থাকাকে অনিরাপদ করে তোলে। ইউক্রেন যুদ্ধের সূচনালগ্নে পুতিনের লালগালিচায় পা রাখা ইমরানের রাজনীতির জন্য একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল।
বিশ্ব রাজনীতির নতুন এই সন্ধিক্ষণে ইমরান আরেকটু সমঝে চলতে পারতেন। ইউক্রেন যুদ্ধের রিমোট অন করে মুসলিম বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রধারী একমাত্র দেশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে একসাথে ডিনারে বসে পুতিন মুসলিম বিশ্বের সমীহ আদায়ে সচেষ্ট হলেও ইমরানের পরিণতি হয়েছে নির্মম। ইমরান ভেবেছিলেন এই সুযোগে রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কিনে জনগণকে খুশি করতে পারবেন। কিন্তু এটাই তার রাজনৈতিক জীবনের এখন পর্যন্ত বড় ট্র্যাজেডি। আদতে এটা কেবল ইমরান খানই নয়; প্রতিটি পপুলিস্ট পলিটিশিয়ানেরই রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি।
তবে আশার কথা হচ্ছে, ক্যাপ্টেন খানের রাজনীতির ধরণ হচ্ছে পপুলিজম উইথ মেনিফেস্টো। কেবল সস্তা একটিভিজম ভিত্তিক পপুলিজমের চর্চা তিনি করেননি। হয়তো এটাই তাকে কাম ব্যাক করার সুযোগ করে দিতে পারে; হয়তো না। আর সেটা দেখার জন্য আমাদের চোখ রাখতে হচ্ছে আগামীতে।