■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় এই ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নেভায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা ছয়টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মিছিল জাপা কাকরাইল কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। এ সময় কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত থাকা কয়েকজন নেতাকর্মী মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতেই শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে ঢাবি থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্র ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়ে কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় জাপা নেতাকর্মীরা প্রতিহত করার চেষ্টা করলে লাঠিসোটা নিয়ে ছাত্ররা তাদের ধাওয়া করে। পরে কাকরাইল ছেড়ে চলে যান দলীয় নেতাকর্মীরা।
আগুনের খবর পেয়ে সাড়ে সাতটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক গাড়ি আগুন নেভাতে এলেও উত্তেজিত ছাত্ররা কার্যালয়ে সামনে ঢুকতে দেয়নি। তবে পুলিশের সহায়তায় পাঁচ মিনিটেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো কাকরাইল ও পল্টন এলাকা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এক সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় পল্টন-বিজয়নগর সড়ক।
উত্তেজিত ছাত্ররা আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকে। এ সময় বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হলেও ছাত্রদের নির্বৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ নিরব ভূমিকা রাখে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন রশিদ বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতাকে নিয়ে মিছিল শুরু করি। বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কির সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে মিছিল শেষ হওয়ার কথা। তবে মিছিলটি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপর্যুপরি আক্রমণ করা হয়। আমাদের প্রায় ২০ জন আহত হয়েছেন।’
এ বিষয়ে হাসান আল মামুন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের আগে থেকেই অবস্থান ছিল। মিছিলটি আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা এক হয়ে প্রতিরোধ গড় তোলেন।’
এর আগে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ‘পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অপতৎপরতা ও দেশবিরোধী চক্রান্তের’ প্রতিবাদে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র শ্রমিক জনতা’ ব্যানারে মশাল মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই বলে জানান বক্তারা। তারা বলেন, রাজনৈতিক অতৎপরতা ও দেশবিরোধী চক্রান্ত এই দেশে হবে না। পরে তারা জাতীয় পার্টির কার্যালয় ঘেরাও করতে বিজয়নগরে যান। সেখানে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ছাত্র-জনতার। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হন। এরপরই জাতীয় পার্টিকে জাতীয় ‘বেঈমান’ আখ্যা দিয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে বিজয়নগরের উদ্দেশে মিছিলের ডাক দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ হাসিব বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে টিএসসি থেকে মশাল মিছিল নিয়ে জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে আসেন তাঁরা। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে ব্রিফিংয়ের পরিকল্পনা ছিল। যেন আগামী ২ তারিখ জাতীয় পার্টি তাঁদের মহাসমাবেশ করতে না পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মিছিলটি যখন পার্টি অফিসের সামনে চলে আসে, তখন দলটির নেতা-কর্মীরা আক্রমণ করে। সেই আক্রমণে ১০-১৫ জন আহত হন।
আহত হওয়ার খবরটি সমন্বয়কদের কাছে চলে গেলে, তাঁরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে সামনে আসতে চায়। ততক্ষণে সাধারণ মানুষসহ শিক্ষার্থীরা জাতীয় পার্টির অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়, ভাঙচুর করে এবং এরশাদের ছবিসহ লোগো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলে।
জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বলেন, স্বাধীন এ দেশে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে সহায়তা করা এই জাতীয় পার্টি কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ করতে পারবে না। যেকোনো মূল্যে তাঁদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হবে।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (রাত ৯ টা) ছাত্র-জনতার অন্তত ১৫০-২০০ জন জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে স্লোগান দিচ্ছেন। পরিচিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি টহল টিম সেখানে উপস্থিত রয়েছে।
সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দুটি স্ট্যাটাসের দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। এতে তিনি জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ আনেন। সন্ধ্যা ৭টা ৩ মিনিটে দেওয়া পোস্টে তিনি লেখেন, ‘জাতীয় বেইমান এই জাতীয় পার্টি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিজয়নগরে আমাদের ভাইদের পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এবার এই জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত নিশ্চিত।’
কিছুক্ষণ পর আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘রাজু ভাস্কর্য থেকে সাড়ে ৭টায় মিছিল নিয়ে আমরা বিজয়নগর মুভ করব। জাতীয় বেঈমানদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু রাত আটটার দিকে বলেন, তাঁরা আগামী শনিবার কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে সমাবেশ করতে পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়েছেন। আজ জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যার পরে শাহবাগ থেকে একটি মশালমিছিল নিয়ে একদল লোক কার্যালয়ে হামলা করে।
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, কর্মীদের প্রতিরোধে হামলাকারীরা মার খেয়ে পালিয়ে যায়। আধা ঘণ্টা পর সংঘবদ্ধ হয়ে ফিরে তারা কার্যালয়ে আগুন দেয়। তিনি আরও বলেন, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস এসেছিল। তাদের আগুন নেভাতে দেওয়া হয়নি। মুজিবুল হক বলেন, ‘এভাবে যদি একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে হামলা হয়, তাহলে দেশে কিসের গণতন্ত্র, কিসের রাজনীতি।’