■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান বলছে, গত অক্টোবর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৪৩টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৬৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৮৩৭ জন। যাদের মধ্যে ৭৪ জন নারী ও ৬৬টি শিশু রয়েছে। আর মোট ২০৮টি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৯৬ জন।
রোববার (১০ নভেম্বর) রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২৬ জন নিহত হয়েছিল। এই হিসাবে অক্টোবরে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে ১১ দশমিক শূণ্য ১ শতাংশ; মৃত্যুর হার বেড়েছে ১০ দশমিক শূণ্য ৯ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৪ দশমিক ২ জন। অক্টোবর মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে ১৫ দশমিক ১২ জন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনা কিছুটা কমে এলেও অক্টোবরে সেই সংখ্যা ফের শতকের ঘর ছাড়িয়েছে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত অক্টোবর মাসে দুর্ঘটনায় ১০২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ বছর জুন মাসে সর্বোচ্চ ১২৮ জন পথচারী সড়কে প্রাণ হারান; সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৯৭ জন। এর আগের তিন মাসে এই সংখ্যাটি শতকের ঘর ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩ জন শিশু ও ৫৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
২০৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৯৬ জন, যা মোট নিহতের ৪১.৭৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৬.৯৫ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১০২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১.৭৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৭ জন, অর্থাৎ ১৪.২৮ শতাংশ।
এই সময়ে ৪টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত, ৩ জন আহত হয়েছেন। ২১টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৯৬ জন (৪১.৭৯%), বাসের যাত্রী ৩১ জন (৬.৬০%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রলি-লরি আরোহী ২০ জন (৪.২৬%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ১২ জন (২.৫৫%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টমটম) ৯৪ জন (২০.০৪%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-ভটভটি-আলমসাধু-ধান মাড়াই গাড়ি-পাওয়ারটিলার) ১০ জন (২.১৩%) এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ৪ জন (০.৮৫%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৭৩টি (৩৯.০৫%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৬২টি (৩৬.৫৬%) আঞ্চলিক সড়কে, ৬৪টি (১৪.৪৪%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৩৮টি (৮.৫৭%) শহরের সড়কে এবং ৬টি (১.৩৫%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনাসমূহের ১১২টি (২৫.২৮%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৭১টি (৩৮.৬০%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৪টি (২৩.৪৭%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৪২টি (৯.৪৮%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৪টি (৩.১৬%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রামট্রাক- আঠার চাকার লরি ২৫.৪৮%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৪.৩৯%, যাত্রীবাহী বাস ১৪.৪৮%, মোটরসাইকেল ২৮.০৭%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টমটম) ১৭.৫৯%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-আলমসাধু–মাহিন্দ্র-হ্যালোবাইক-ধান মাড়াই গাড়ি-পাওয়ারটিলার) ৫.৪৩%, বাইসাইকেল-রিকশা ১.৮১% এবং অজ্ঞাত যানবাহন ২.৭১%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৭৭৩টি। (বাস ১১২, ট্রাক ১১৯, কাভার্ডভ্যান ২২, পিকআপ ২৫, ট্রাক্টর ৭, ট্রলি ৬, লরি ৯, ড্রাম ট্রাক ৮, আঠার চাকার লরি ১, মাইক্রোবাস ১২, প্রাইভেটকার ১৪, অ্যাম্বুলেন্স ৫, জীপ ৩, মোটরসাইকেল ২১৭, থ্রি-হুইলার ১৩৬ (ইজিবাইক- সিএনজি- অটোরিকশা- অটোভ্যান-টমটম), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪২ (নসিমন- করিমন-ভটভটি- আলমসাধু- মাহিন্দ্র- হ্যালোবাইক-ধান মাড়াই গাড়ি-পাওয়ারটিলার), বাইসাইকেল-রিকশা ১৪ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ২১টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫.৪১%, সকালে ২৬.৬৩%, দুপুরে ১৬.৯৩%, বিকালে ১৫.৫৭%, সন্ধ্যায় ৯.২৫% এবং রাতে ২৬.১৮%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৯.৫৭%, প্রাণহানি ৩০.৭০%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৩৪%, প্রাণহানি ১৩.৮৫%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৭.৮৩%, প্রাণহানি ১৭.২৭%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯%, প্রাণহানি ৮.১০%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৪.০৬%, প্রাণহানি ৫.৩৩%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪.৯৬%, প্রাণহানি ৫.১১%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১০.৮৩%, প্রাণহানি ১১.০৮% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.৩৫%, প্রাণহানি ৮.৫২% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৩১টি দুর্ঘটনায় ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ২২টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম মাগুরা, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পঞ্চগড় জেলায়। এই ৪টি জেলায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি।
রাজধানী ঢাকায় ২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত এবং ৩৪ জন আহত হয়েছে।
নিহতদের পেশাগত পরিচয়:
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পুলিশ সদস্য ৩ জন, আনসার সদস্য ২ জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ৯ জন, সাংবাদিক ৪ জন, প্রকৌশলী ২ জন, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৭ জন, বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৬ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২১ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ২৭ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৪ জন, পোশাক শ্রমিক ১১ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৬ জন, প্রতিবন্ধী ৪ জন এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন ছাত্রীসহ দেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজের ৫৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০. “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য:
গত সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২৬ জন নিহত হয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৪.২ জন। অক্টোবর মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে ১৫.১২ জন। এই হিসাবে অক্টোবর মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ৬.৪৭%।
অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারী এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। বেপরোয়া যানবাহন এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। তাই, সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে বাস এবং পণ্যবাহী যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের মধ্যে জীবনবোধ ঠিকমতো কাজ করে না। পণ্যবাহী যানবাহন চালকদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। এজন্য পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। মোটকথা, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।