■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
ভারতের আগরতলার কুঞ্জবনে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র-জনতা।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
এ সময় বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা এসে মিছিলে যোগ দেন। পরে মিছিলটি ভিসি চত্বর হয়ে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে এক সমাবেশে মিলিত হয়।
শিক্ষার্থীরা ‘গোলামী না আজাদি, আজাদি আজাদি’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘ভারতীয় আগ্রাসন, রুখে দাও জনগণ’; ‘হাইকমিশনে/আগরতলায় হামলা কেন, দিল্লি তুই জবাব দে’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানান।
মিছিলের পর বিক্ষোভ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, তারা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে, প্রতিবেশী হিসেবে ভালো সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে আমাদের রাজা-প্রজার সম্পর্ক হতে পারে না। ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলার জন্য অবশ্যই ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে।
তারা আরও বলেন, ভারতকে বলতে চাই— এ দেশে আর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নেই। সুতরাং তারা যেন আওয়ামী লীগের আমলের মতো করে এ দেশে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে। দিল্লিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই— শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকা পর্যন্ত আমরা ভারতের আধিপত্য মেনে নেব না। যেভাবে আমরা হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছি সেভাবেই আমরা দিল্লির আগ্রাসনও রুখে দেব।
সমাবেশে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার বিশ্বের ইতিহাসে আজকে একটি নগ্ন ঘটনার জন্ম দিল। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কোনো দেশের জনগণ অন্য কোন দেশের দূতাবাসে আক্রমণ, হামলা তো দূরের কথা, অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারে না। আজকে এই বিজেপির উগ্র বিজেপি সরকারের নেতাকর্মীরা, ইসকনের এই উগ্র সন্ত্রাসীরা, জঙ্গিরা, আরএসএস-এর সন্ত্রাসীরা দূতাবাসে হামলা করে প্রমাণ করে দিল যে তারা সভ্য জাতি কিনা, তারা বিশ্বের যে একটি সভ্যতা যে ভদ্রতা সেটি ধারণ করে কিনা।
তিনি ভারতের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, আজকে ভারতে যে ঘটনা ঘটেছে এটি কি আপনাদের সভ্যতা ভদ্রতার পরিচয় প্রকাশ করে কিনা। যদি আপনারা সমর্থন করেন তাহলে বাংলাদেশের মানুষও সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে।
জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর কাফি সমাবেশে বলেন, আমরা সবেমাত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ পেলাম। এখনো অনেকের চোখ নেই, পা নেই, অনেকে কবরে শুয়ে আছে। এসবের জন্য তাদের মায়াকান্না হয় না। তাদের মায়াকান্না হয় হাসিনার ক্ষমতার জন্য। আমরা তাদেরকে ক্ষমতার স্বাদ পুনরায় নিতে দেব না। দিল্লির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে চোখে চোখ রেখে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আগরতলার ঘটনায় বিক্ষোভ করেছে। সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে ভাস্কর্য চত্বরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়।
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারত যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোকে আমরা অস্থির করে তুলব। আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে তারা অসহায়।’
আইন বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের অফিস সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মুহাম্মদ বিন কাসেমের উত্তরসূরী। আমাদের রক্তে খালিদ বিন ওয়ালিদের সাহসিকতা। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা হিন্দুত্ববাদী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সর্বদা প্রস্তুত।’
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা হস্তক্ষেপ করিনি, কিন্তু তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আগরতলার ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে মশাল মিছিল বের করেন তারা। মিছিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই জায়গায় এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে শেষ করে।
মিছিলে অংশ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন, বিপ্লবী সাংস্কৃতিক মঞ্চ, আধিপত্যবাদ বিরোধী মঞ্চ, জাহাঙ্গীরনগর সংস্কার আন্দোলন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘মোদির দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘তুমি কে আমি কে? বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তুমি কে আমি কে? সাইফুল সাইফুল’, ‘আবু সাইদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘দূতাবাসে হামলা কেন? মোদি তুই জবাব দে’, ‘ইসকনের আস্তানা, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়াম বলেন, ‘শেখ হাসিনা ভারতের পুতুল। আমাদের এই অভ্যুত্থান ছিল ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। যারা ২৪’কে ৭১ এর বিরুদ্ধে দাড় করাতে চায় তারা ভারতের দালাল। শেখ হাসিনার মত শক্তিশালী স্বৈরশাসককে সরাইতে ৩৬ দিন সময় লাগছে। কেউ আধিপত্য দেখাতে আসলে তাদের অবস্থা ভয়াবহ হবে।’
গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আব্দুর রশীদ জিতু বলেন, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক হবে দ্বিপাক্ষিক সমতার ভিত্তিতে। দল-মত, ধর্মীয় মতাদর্শ ভুলে এক হতে আমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে দেশের জন্য লড়াই করে যাব। ২৪’র পরাজিত শক্তিরা এক দিনের জন্যও ষড়যন্ত্র করা থেকে বসে নেই। তারা অন্তবর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্র চালাতে বিভিন্নভাবে বাধা দিচ্ছে। আমরা বলতে চাই তোমাদের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে আমরা বিশ কোটি জনগণ প্রস্তুত।’
এদিকে, রাজধানীর উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের মুগ্ধ মঞ্চের সামনে রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছে নাগরিক কমিটি ও স্থানীয় ছাত্র-জনতা।
প্রায় ৫০ জনের এই মিছিলে শ্লোগান দেওয়া হয়, ‘ভারতীয় মাস্তানি ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও,’ ‘আমরা বাংলার দামাল ছেলে, ভারত তোমায় ভয় করি না।’
এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংসদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এবং নিরাপদ বাংলাদেশ চাইসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
বিক্ষোভ মিছিলগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। ঢাবির শিক্ষার্থী জাহিদ আহসান বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশী, কিন্তু তাদের সঙ্গে রাজা-প্রজার সম্পর্ক নয়, সমমর্যাদার সম্পর্ক চাই।’
রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল
রংপুরে যৌথভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। রাত আটটার দিকে নগরের প্রেসক্লাব চত্বর থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক ঘুরে আবার প্রেসক্লাবে ফিরে আসে।
পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ, সদস্যসচিব রহমত আলী, মুখ্য সংগঠক আলী মিলন, মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকার, রংপুর জেলার আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ, সদস্যসচিব আসফাক আহমেদ, মুখপাত্র ইয়াসির আরাফাত, জাতীয় নাগরিক কমিটির সংগঠক আলমগীর নয়ন প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তাঁরা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা সহ্য করতে পারে না। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়েছে। ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যম বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে অভিযোগ করে বক্তারা প্রতিটি সীমান্ত হত্যার বিচার এবং ভারতের সঙ্গে করা দুই দেশের অসম চুক্তিগুলো বাতিলের দাবি জানান।
এদিকে রাত নয়টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
খুলনায় বিক্ষোভ মিছিল
খুলনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল। আজ রাতে নগরের শামসুর রহমান রোডেছবি: প্রথম আলো
খুলনা শহরে রাত সাড়ে নয়টায় নগরের শামসুর রহমান রোড থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মিছিলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে ট্রাফিক মোড়ে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
ফেনীতে বিক্ষোভ মিছিল
সোমবার রাত সোয়া নয়টার দিকে ফেনী শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল বের হয়ে শহরের দোয়েল চত্বর, প্রেসক্লাব, বড় মসজিদ ও মডেল থানা প্রদক্ষিণ করে খেজুর চত্বর এসে সমাবেশে মিলিত হয়।
সেখানে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেনীর সমন্বয়ক ওমর ফারুক, ছাগলনাইয়ার সমন্বয়ক নাঈম ফরায়জী, হেফাজত ইসলামের কর্মী রেদওয়ান উল্যাহ ইউসুফী, ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী রাফিতুল ইসলাম প্রমুখ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মশাল মিছিল
হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সোমবার রাত নাড়ে নয়টার দিকে ক্যাম্পাসের বটতলা এলাকা থেকে মশাল মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরসহ কয়েকটি সড়ক ঘুরে আবার বটতলায় গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে একটি সমাবেশ করেন তাঁরা। সেখানে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়াম, ছাত্রশিবিরের জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মুহিবুর রহমান, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আবদুর রশিদ।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে মশালমিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সোমবার রাত পৌনে ১০টার দিকেছবি: প্রথম আলো
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে আজ সোমবার দুপুরের দিকে হামলা চালিয়েছে হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা। এ ঘটনাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলছে, হিংসাত্মক বিক্ষোভ ও হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে ক্ষুব্ধ।