■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত ভোক্তা মূল্য সূচকে (সিপিআই) এ চিত্র উঠে এসেছে।
বিবিএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে চেয়ে দশমিক ৫১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে নভেম্বরে মাসে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি আশঙ্কার জায়গায় গিয়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি নাগালের বাইরে গিয়ে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কোনো দেশ বা অঞ্চলের সামগ্রিক পণ্য বা সেবার দাম বাড়ার প্রবণতাকে নির্দেশ করে মূল্যস্ফীতি। তবে অর্থনৈতিক সংকোচনের কারণে এর উল্টো ঘটনা ঘটে, যা ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে অনেক মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের উপরে রয়েছে। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ আঞ্চলিক সংঘাতের প্রভাবের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও এর জন্য দায়ী।
গত নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো—২০২৩ সালের নভেম্বরে যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল, এবার তা কিনতে হয়েছে ১১৩ টাকা ৩৮ পয়সায়। একইভাবে খাদ্যের ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অর্থ যে খাদ্যপণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল, সেটা এখন ১১৪ টাকা ৬৩ পয়সায় উঠেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার পরিকল্পনা আছে সরকারের। ইতিমধ্যে কয়েকবার নীতি সুদহারও বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না গড় মূল্যস্ফীতি।
সিপিআই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের গড় মূল্যস্ফীতি নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে, যেটি আগের মাসেও ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। সদ্য শেষ হওয়া মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে ঠেকেছে, অক্টোবরেও এটি ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে।
তবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশে ঠেকেছে। আগের মাস অক্টোবরে এ খাতের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
গ্রাম ও শহর এলাকার বিবেচনায় শহরের তুলনায় গ্রামে গড় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে বলে উঠে এসেছে সিপিআই তথ্যে। তবে অক্টোবরে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলেও নভেম্বরে এসে এ চিত্র পাল্টে শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে।
নভেম্বরে গ্রাম এলাকার গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশে, শহর এলাকায় তা আছে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে গ্রাম এলাকায় ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশে, যেখানে শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, অক্টোবরে যা ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৪১ ও ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৫ ও ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং গত বছরের নভেম্বরে ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮৬ ও ৮ শতাংশ।
নভেম্বরে শহরাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ; অক্টোবরে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। নভেম্বরে শহরাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৩ ও ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৮ ও ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘বাজার মনিটরিং চলছে ঢিমেতালে। অথচ এটাই প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল। সরকারের অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম ও কমিশনের মতো নিত্যপণ্যের বাজার সংস্কারেও একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকা উচিত ছিল। মন্ত্রী পরিবর্তন হলেও আমলা একই আছে। তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে চক্রের মাধ্যমে বাজারে সিন্ডিকেট বজায় রেখেছেন।’
দেশে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের কাছাকাছি। বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এদিকে মূল্যস্ফীতি আগামী জুন মাসের মধ্যে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সম্প্রতি তিনি এক সেমিনারে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, পরবর্তী অর্থবছরের মধ্যে তা ৫ শতাংশে নামবে। আমাদের মূল লক্ষ্য ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। আশা করি তা সম্ভব।’
মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে সুদের হার কমিয়ে আনা হবে জানিয়ে গভর্নর আরও বলেন, ‘বন্যার কারণে বর্তমান বাজারে সবজি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তি। একসময় তা কমে আসবে। মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে আমরা ব্যাংকের সুদ ও নীতি সুদহার কমিয়ে আনব।’
বিবিএসের মজুরি হার সূচক অনুযায়ী, সর্বশেষ নভেম্বরে শ্রমিকের মজুরি হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ; যা এর আগের মাসে (অক্টোবর ২০২৪) ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
বিবিএস বলছে, গত নভেম্বরে কৃষি, শিল্প ও সেবা- তিন খাতেই মজুরি হার সামান্য পরিমাণে বেড়েছে। এর মধ্যে কৃষি খাতে মজুরির হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে এ খাতে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ এবং অক্টোবরে ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালের নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং অক্টোবরে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যমতে, শিল্প খাতে গত নভেম্বরে মজুরির হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ; যা অক্টোবরে ছিল ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৩ সালের নভেম্বরে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৩০ এবং অক্টোবরে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। এরও আগে ২০২২ সালের নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ এবং অক্টোবরে ছিল ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বিবিএস জানায়, সেবা খাতে গত নভেম্বরে মজুরি হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৩ সালের নভেম্বরে এ হার ছিল ৮ দশমিক ২২ এবং অক্টোবরে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এরও আগে ২০২২ সালের নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১৭ এবং অক্টোবরে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।