বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের অবসান

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

সিরিয়ার বিদ্রোহীরা মাত্র ১২ দিনে পতন ঘটিয়েছে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের এবং বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের।

বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখল ঘোষণার মুখে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে গেছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকেরও বেশি শাসনামলের অবসান মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচএস) জানিয়েছে, সরকারি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। শতাধিক সেনা সদস্য তাদের সামরিক ইউনিফর্ম খুলে ফেলেছেন। তাদের বলা হয়েছে, সরকার পতনের কারণে তারা চাকরি হারিয়েছেন।

দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ উড়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে সূত্র। ধারণা করা হচ্ছে, এই উড়োজাহাজে করেই বাশার আল-আসাদ এবং তার ঘনিষ্ঠরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

২০১১ সালে আরব বসন্তের জের ধরে সিরিয়ার বিক্ষোভ শুরু হয়। ক্রমে তা রুপ নেয় গৃহযুদ্ধে। রাশিয়া আর ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাশার আল আসাদ নিজের ক্ষমতা অনেকটা সংহত করে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া নতুন লড়াইয়ে একের পর এক বড় বড় শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় সরকারী বাহিনী।

রোববার বিদ্রোহী দলগুলো টেলিগ্রাম বার্তায় জানিয়েছে, ‘বাথ পার্টি শাসনের অধীনে ৫০ বছরের নিপীড়নের পরে, এবং ১৩ বছরের অপরাধ ও অত্যাচার এবং (জোর করে) বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর… আমরা আজ এই অন্ধকার সময়ের অবসান এবং সিরিয়ার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা করছি।’

বিদ্রোহীরা বলেন, আমরা সিরিয়ার মানুষদের একটি সুসংবাদ জানিয়ে উদযাপনে মেতে হঠতে চাই। বন্দিদের শৃঙ্খল খুলে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেদনায়া কারাগারে অন্যায়ভাবে মানুষকে বন্দি রাখার কালো যুগের অবসান ঘোষণা করছি।

দামেস্কের শহরতলীতে অবস্থিত সেদনায়া কারাগারে আসাদের সরকার হাজারো মানুষকে বন্দি রেখেছিল।

কয়েক ঘণ্টা আগেই বিদ্রোহীরা ঘোষণা দেয়, তারা গুরুত্বপূর্ণ শহর হোমসের দখল নিয়েছে। মাত্র এক দিনের যুদ্ধেই এই শহর দখল করে নেয় তারা।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর স্বৈরশাসক আসাদ মুক্ত হল দেশটি। দেশের অভ্যন্তরের সংঘাত নিরসনে দীর্ঘ সময় আসাদের পাশে ছিলো রাশিয়া এবং ইরানের মতো শক্তিশালী মিত্ররা। তবে শেষ মুহূর্তে মিত্রদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি।

হোমস থেকে সিরিয়ান সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার পর হাজারো বাসিন্দা রাস্তায় নেমে আসে। তারা নাচতে নাচতে স্লোগান দিতে থাকে,  ‘আসাদ শেষ, হোমস মুক্ত’ এবং ‘সিরিয়া দীর্ঘজীবী হোক, বাশার আল-আসাদ নিপাত যাক।’ বিদ্রোহীরা আকাশে গুলি ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করে। তরুণেরা আসাদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে।

দুই সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর প্রতিরোধ ছাড়াই রাজধানীতে প্রবেশ করেছে। হাজার হাজার গাড়িতে এবং পায়ে হেঁটে দামেস্কের  প্রধান চত্বরে জড়ো হয়ে স্বাধীনতা স্লোগান দিচ্ছিল।

বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছে, তারা রাজধানীর উত্তরে কুখ্যাত সাইদনায়া সামরিক কারাগারে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে তাদের বন্দিদের মুক্ত করেছে।

সিরিয়ার সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনী দামেস্ক বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে, বিদ্রোহীরা রাজধানীতে তীব্র আক্রমণ চালানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে একটি যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা রোববার এ খবর জানিয়েছে।

 প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, হাজার হাজার মানুষ গাড়িতে এবং পায়ে হেঁটে দামেস্কের প্রাণকেন্দ্রে জড়ো হচ্ছেন। “স্বাধীনতা” স্লোগান দিচ্ছেন তারা।

এছাড়া অনলাইনে পোস্ট করা বেশ কিছু ভিডিওতে দামেস্কের উমাইয়াদ স্কোয়ারে বেশ কিছু লোককে পরিত্যক্ত সামরিক ট্যাংকের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে এবং আনন্দ উদযাপনে গান গাইতে দেখা গেছে। আল জাজিরা এসব ভিডিও ফুটেজের সত্যতা যাচাই করেছে।

এদিকে দামেস্কে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। বেশ কিছু ভিডিওতে সিরিয়ার রাজধানী থেকে সরকারি সৈন্যদের শহর ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আল জাজিরা এসব ফুটেজেরও সত্যতা যাচাই করেছে।

এছাড়া দামেস্কের প্রাণকেন্দ্রে গুলির তীব্র শব্দ শোনা গেছে বলে রোববার সেখানকার দুই বাসিন্দা জানিয়েছেন। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে গোলাগুলির উৎস কী তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

এছাড়া ব্রিটেন-ভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের সূত্র জানায়, সরকারি বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈন্যরা দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, কারণ রাজধানীর বাসিন্দারা এএফপিকে বলেছেন, তারা শহরে গুলির শব্দ শুনেছেন।

১৯৭০ সালে সামরিক বাহিনীর জেনারেল হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করেন।

হাফিজ শক্ত হাতে তিন দশকের বেশি সময় সিরিয়া শাসন করেন। তিনি সিরিয়াকে ক্রমেই মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে নিতে থাকেন। 

নিজের গোত্র আলাওয়াতিদের হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ এনে দেন।  গোটা দেশে নিজের ধ্যান ধারণা আর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা প্রচার করার পাশাপাশি নিজের ক্ষমতাও অনেক বাড়িয়ে নেন। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। এরপর থেকে হাফিজ আল আসাদের কনিষ্ঠ ছেলে বাশার আল আসাদ প্রায় দু যুগ ধরে স্বৈরাাচারি কায়দায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন। 

বাশার আল-আসাদের দ্রুত পতন যেসব কারণে

মার্কিন থিংক ট্যাংক নিয়ার ইস্ট সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড ডেস রোচেস সিরিয়ার বিদ্রোহীদের দ্রুতগতির আক্রমণের সাফল্যকে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর ‘মনোবল ও নেতৃত্বের অভাব’ বলে উল্লেখ করেছেন।

রোচেস কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেন, ‘২০১৪ সালে ইরানি ও রুশ বাহিনীর হস্তক্ষেপের সময় থেকে আমরা শুনতে শুরু করি যে, সিরিয়ান আরব বাহিনীর (সিরিয়ার সরকারি বাহিনী) নেতৃত্ব সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। তারা যুদ্ধের চেয়ে বেসামরিক জনগণের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ে বেশি মনোযোগী। প্রকৃত যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছিল মূলত ইরান সমর্থিত বিভিন্ন প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে। রাশিয়ার বিমানশক্তি এই প্রক্সি বাহিনীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছিল।’

এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘রাশিয়া বিমানবাহিনীর সমর্থন সরিয়ে নেওয়ার পর ইরান সমর্থিত প্রক্সি বাহিনী যুদ্ধ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এর পর যুদ্ধ করার জন্য বাকি থাকে কেবল মনোবলহীন, দুর্বল নেতৃত্বাধীন, অপর্যাপ্তভাবে সজ্জিত এবং সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সশস্ত্রবাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকে না।’

এ ছাড়া, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে তুরস্কের তরফ থেকে সরাসরি না হলেও চুপিসারে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের সাফল্য কামনা করেছেন। গত শুক্রবার এরদোয়ান বলেন, ‘…ইদলিব, হামা, হোমস এবং অবশ্যই লক্ষ্য হলো দামেস্ক। বিরোধীদের মার্চ অব্যাহত রয়েছে। আমাদের ইচ্ছা, সিরিয়ায় এই অগ্রগতি কোনো দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় ছাড়াই চলতে থাকবে।’ সিরিয়ার নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা (বাশার আল—) আসাদকে আহ্বান জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আসুন, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ একসঙ্গে নির্ধারণ করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’

সিরিয়া যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ যত ঘটনা

সিরিয়ায় ১৩ বছরের যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

এই দীর্ঘ সংঘাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জেনে নেওয়া যাক:

মার্চ, ২০১১: দামেস্ক ও দারায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুরু হয়। আল-আসাদ সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস দমন-পীড়ন চালায়, যা এক সশস্ত্র বিপ্লবের জন্ম দেয়।

জুলাই, ২০১২: আলেপ্পোতে সংঘর্ষ তীব্র হয়ে ওঠে। সেখানে বিরোধী বাহিনী শহরের বড় অংশ দখল করে নেয়। চার বছর পর সিরীয় সেনারা শহরটি পুনরুদ্ধার করে।

আগস্ট, ২০১৩: পূর্ব ঘৌতায় এক রাসায়নিক হামলায় শত শত নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। এই হামলার পর আন্তর্জাতিক মহল তীব্র নিন্দা জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদ সরকার রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

জুন, ২০১৪: আইএসআইএল সিরিয়া ও ইরাক জুড়ে খিলাফত ঘোষণা করে, বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয় তারা। রাকা শহরটি সিরিয়ায় তাদের কার্যত রাজধানী হয়ে ওঠে। তাদের নিয়ন্ত্রণ ২০১৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

সেপ্টেম্বর, ২০১৫: রাশিয়া সরাসরি আল-আসাদ সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। রুশ বিমান হামলা সরকারি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধের গতি পরিবর্তন করে দেয়।

এপ্রিল, ২০১৭: যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ার সরকারি স্থাপনাগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। খান শেখুনে রাসায়নিক হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই অভিযান শুরু করার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ছিল সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ।

নভেম্বর, ২০২৪: গত চার বছরে এই সংঘাত মূলত এক স্থিতিশীল অবস্থায় পরিণত হয়। গত সপ্তাহে ইদলিব থেকে সশস্ত্র গ্রুপগুলো হঠাৎ করেই অভিযান শুরু করে। আকস্মিক আঘাতে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে সরকারি বাহিনী। একের পর এক শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে আসাদ বাহিনী। শেষ পর্যন্ত আজ রোববার রাজধানী দামেস্ক পতনের আগেই প্রেসিডেন্ট আসাদ দেশ ছাড়েন।

সম্পর্কিত লেখা:

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *