ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশের ইতিহাস

■ ক্রীড়া প্রতিবেদন ■

শেষ ম্যাচে ৮০ রানের ব্যবধানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে প্রথমবারের মতো হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ।

২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের পর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে প্রতিপক্ষকে তাদের মাঠে হোয়াইটওয়াশের স্বাদ পেল বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ডের পর চতুর্থ দল হিসেবে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ।

সেন্ট ভিনসেন্টে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ১৮৯ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। ৪১ বলে সর্বোচ্চ অপরাজিত ৭২ রান করেন জাকের আলী। জবাবে খেলতে নেমে ১৬ ওভার ৪ বলে ১০৯ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের ০.৫ ওভারে খেলার পরই হানা দেয় বৃষ্টি। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মিনিট বিশেক পরই আবার খেলা শুরু হয়। দ্বিতীয় ওভারেই স্পিন আক্রমণে যায় বাংলাদেশ। নতুন বলে আরো একবার দুর্দান্ত শুরু করেন শেখ মেহেদি। নিজের প্রথম ওভার করতে এসেই উইকেটের দেখা পান। এই ডানহাতি অফ স্পিনারকে লং অন দিয়ে ছক্কা মারতে গিয়ে বদলি ফিল্ডার আফিফ হোসেনের হাতে ধরা পড়েন জাস্টিন গ্রিভস। তাতে ৭ রান তুলতেই ২ উইকেট হারায় উইন্ডিজ।

এরপর নিকোলাস পুরাণ ও জনসন চার্লস জুটি গড়ার চেষ্টা করেন। তবে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে গিয়ে ফেরেন পুরাণ। এই অভিজ্ঞ ব্যাটারকে বোকা বানিয়েছেন মেহেদি। অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে নিচু হয়ে ভেতরে ঢোকা বলে লাইন মিস করে বোল্ড হয়েছেন পুরাণ। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১০ বলে ১৫ রান।

পাঁচে নেমে শূন্য রান আউট হন রোস্টন চেইস। চার বল খেলে রানের খাতা খোলার আগেই হাসান মাহমুদের বলে মেহেদির হাতে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি। এক প্রান্ত আগলে রাখা চার্লস ফিরেছেন রান আউটের শিকার হয়ে। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৮ বলে ২৩ রান। তাতে দলীয় ফিফটির আগেই ৫ উইকেট হারায় উইন্ডিজ।

লোয়ার মিডল অর্ডারে রোভম্যান পাওয়েল-গুড়াকেশ মোতিরাও ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। রোমারিও শেফার্ডের ২৭ বলে ৩৩ রানের ইনিংস কেবলই জয়ের ব্যবধান কমিয়েছে।

বাংলাদেশের হয়ে ২১ রানে ৩ উইকেট শিকার করে ইনিংসের সেরা বোলার রিশাদ হোসেন। তাছাড়া তাসকিন ও মেহেদি দুটি করে উইকেট পেয়েছেন। আর একটি করে উইকেট পেয়েছেন তানজিম সাকিব ও হাসান মাহমুদ।

এর আগে লিটনের সঙ্গে ইনিংস ওপেন করতে নেমে রীতিমতো ঝড় তোলেছিলেন পারভেজ হোসেন ইমন। তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে উড়ন্ত শুরু পায় বাংলাদেশ। অফফর্মে থাকা লিটনকেও আজ বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। দারুণ কিছু শটও খেলেছেন। তবে ১৪ রানের বেশি করতে পারলেন না। অধিনায়ক ফেরায় ভাঙে ৪৪ রানের উদ্বোধনী জুটি।

লিটন ফেরার পর আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি ইমন। দুর্দান্ত ব্যাটিং করা এই ওপেনার আলজারি জোসেফকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ধরা পড়েন জাস্টিন গ্রেভসের হাতে। সাজঘরে ফেরার আগে ২১ বলে ৩৯ রান করেন তিনি। যেখানে ৪টি চার ও ২টি ছক্কা মারেন ইমন। ইমনের দুর্দান্ত ইনিংসে ভর করে পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ ২ উইকেটে ৫৪ রান তোলে।

তিনে নেমে ভালো শুরুর আভাস দিলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি তানজিদ তামিম। এক ছক্কায় ৯ বলে ৯ রান করেছেন এই টপ অর্ডার ব্যাটার।

৬৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে কিছুটা ব্যকফুটে গেলে আরো একবার দলের হাল ধরেন মেহেদি হাসান মিরাজ ও জাকের আলি। চতুর্থ উইকেট জুটিতে শুরুতে দুজনে কিছুটা রক্ষণাত্মক ব্যাটিং করেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাত খুলেছেন। আর রানের গতি বাড়াতে গিয়েই ফিরেছেন মিরাজ। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ২৩ বলে ২৯ রান।

শামিম হোসেন গত দুই ম্যাচে দারুণ ব্যাট করলেও ২ রান করে জাকেরের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়েছেন। একই পথে হেটেছেন শেখ মেহেদিও।

দুই ব্যাটারের রান আউটের সঙ্গেই ছিল জাকেরের নাম। তাই বাড়তি দায়িত্ব ছিল তার ওপর। সেটা ভালোভাবেই পুষিয়ে দিয়েছেন এই উইকেটকিপার ব্যাটার। শুরুতে কিছুটা ধীরগতির ব্যাটিং করলেও ফিনিশিংটা করেছেন দুর্দান্ত। এক প্রান্তে রীতিমতো টর্নেডো বইয়ে দিয়ে ৩ চার ও ৬ ছক্কায় ৪১ বলে করেছেন অপরাজিত ৭২ রান।

জাকেরকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন তানজিম সাকিব। এক চার ও এক ছক্কায় ১২ বলে ১৭ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে।

টি-টোয়েন্টি সিরিজে ম্যান অব দ্য সিরিজ মেহেদী। সিরিজে সর্বোচ্চ ৮ উইকেট নিয়েছেন ৪.১৮ ইকোনমিতে। ব্যাটিংয়ে করেছেন ৩৭ রান।

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশের ইতিহাস

ম্যাচসেরা জাকের যা বললেন

রানআউটের এ ঘটনা নিয়ে ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন জাকের। জানিয়েছেন, ট্যানেল হয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে এবং সেখানে পৌঁছে কীভাবে ক্ষোভ ঝেড়েছেন,  ‘এটা ভয়াবহ ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ড্রেসিংরুমে গিয়ে আমি নিজেকে, ব্যাটে এবং আশপাশে যা কিছু ছিল, সবকিছুতে লাথি মারছিলাম। আর তখনই তাৎক্ষণিকভাবে থার্ড আম্পায়ার (ফোর্থ আম্পায়ার) আমাকে ডেকে নিলেন।’

দুঃখজনক ব্যাপার হলো,  মাঠে ফিরে একই ওভারে মেহেদীর রানআউটের কারণ জড়িয়ে যান জাকের। সেই রানআউটটি নিয়েও বেজায় দুঃখ জাকেরের। তাৎক্ষণিক নিজেকে নিজে লাথি মারার ইচ্ছা জেগেছিল তার। তিনি বলছেন, ‘আমার কারণে আরও একটি রানআউট হয়েছে। নিজেকে লাথি মারার ইচ্ছা হচ্ছিল আমার এবং সে সময় আমি ভেঙেও পড়েছিলাম। তবে আলহামদুলিল্লাহ। এরপর আমি দলের জন্য রান করার সুযোগ পেয়েছি এবং তাদের (শামীম ও মেহেদী) রানও করতে পেরেছি।’

একই ওভারে দুজনের ক্রিজছাড়া হওয়ার কারণ জাকের। নিশ্চয়ই তাকে বিষয়টি পুড়িয়েছে বেশ। তবে ব্যাট হাতে দারুণভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন কড়ায় গণ্ডায়। ইনিংসের শেষ ওভারে ৩ ছক্কায় ২৫ রান নেওয়া ছাড়া সফরজুড়ে সফল তিনি।  টেস্ট (চার ইনিংসে ৪৪.০০ গড়ে ১৭৬ রান) এবং ওয়ানডের (তিন ম্যাচে ৫৬.৫০ গড়ে ১১৩) পর ভূমিকা রেখেছেন টি-টোয়েন্টি সিরিজেও (তিন ম্যাচে ৬০.০০ গড়ে ১২০)। সঞ্চালকের প্রতি উত্তরে নিজের পারফরম্যান্স জাকের মূল্যায়ন করলেন এভাবে, ‘এ সিরিজটা আমার জন্য দারুণ ছিল। টেস্ট সিরিজ, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিজুড়ে ভালো করেছি। আমার মনে হচ্ছিল আজকের উইকেট আগের দুই ম্যাচের তুলনায় ভালো ছিল। আমি সময় নিয়ে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমি নিজেকে চিনি। জানতাম যদি লম্বা সময় খেলতে পারি, তবে আমি রান করতে পারব।’

বাংলাদেশ জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ আগেই নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ দল। আজ শুক্রবার শেষ ম্যাচ জিতে ক্যারিবিয়ানদের হোয়াইটওয়াশ করল টাইগাররা। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ অধিনায়ক  লিটন দাস জানালেন ওয়ানডে সিরিজ হারলেও টি-টোয়েন্টি সিরিজ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল দল। 

বোলারদের প্রশংসা করে লিটন বলেন, ‘টেস্টে আমরা দারুণ খেলেছি, ওয়ানডেতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা জিততে পারিনি কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল। (বোলিং আক্রমণ বিশ্বের যেকোন দলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে প্রশ্নে) হ্যাঁ, আমরা জানতাম ভালো রান করতে পারলে সেটা ডিফেন্ড করার মতো বোলার আমাদের আছে।’

কোচিং স্টাফ-টিম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে লিটন দাস বলেন, ‘(ফিল সিমন্স) সে কখনোই চাপ দেয় না, আমরা স্বাধীনভাবে খেলছি। শুধু সে না পুরো কোচিং স্টাফ এবং টিম ম্যানেজমেন্ট অনেক সাহায্য করছে। আমরা প্রতিনিয়ত উন্নতি করছি, উইকেট ভালো ছিল ব্যাটিংয়ের জন্য এবং বোলাররা যে মনোভাব দেখিয়েছে তা অসাধারণ ছিল।’

এই হোয়াইটওয়াশকে বড় অর্জন মনে করে লিটন বলেন, ‘এই মুহুর্তে তাদের ব্যাটিং আমাদের চেয়ে ভালো, তাদের পাওয়ার হিটার রয়েছে কিন্তু আমরা ১৯০ ডিফেন্ড করেছি এটা বড় অর্জন। এই সিরিজে আমরা ভালো খেলেছি এবং পরবর্তীতে যেখানেই খেলব আমাদের ভালো খেলতে হবে।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করার ম্যাচে টাইগারদের যত রেকর্ড

২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের পর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে প্রতিপক্ষকে তাদের মাঠে হোয়াইটওয়াশের স্বাদ দিলো বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ডের পর চতুর্থ দল হিসেবে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে একাধিক ম্যাচের সিরিজে এটি বাংলাদেশের ষষ্ঠবারের মতো প্রতিপক্ষকে ধবলধোলাই করার কীর্তি।

এ ছাড়া স্মরণীয় সিরিজে আরও যত রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ-

‘৩৪ ছক্কা’

এক বছরে বাংলাদেশের হয়ে তিন ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ড হয়েছে। রেকর্ড ছক্কা হাঁকিয়েছেন জাকের আলী। ৩৪টি। পেছনে পড়েছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ৩০ (২০১৮ সাল) ও আফতাব আহমেদের ২৯ ছক্কা (২০০৬ সাল)। 

‘৮০ রান’

দুই দেশের মধ্যকার টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রানের ব্যবধানের জয়। ৮০ রান। এর আগে উইন্ডিজ জিতেছিল ৭৩ রানে। 

‘১০৯ ম্যাচ’

টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হারের রেকর্ড এখন উইন্ডিজদের। হেরেছে ১০৯ ম্যাচ। বাংলাদেশ এতদিন সবচে বেশি ছিল। ক্যারিবিয়ানদের সিরিজ হারিয়ে নিজেদের বাজে রেকর্ড থেকে মুক্ত করেছে লিটন বাহিনী।

‘৩’

মাত্র ২য় বাংলাদেশি হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে শেষ ওভারে ৩টা ছক্কা জাকেরের। এর আগে, সৌম্য সরকার। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। ৯ই মার্চ, ২০২০।  

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে শেষ ওভারে সর্বোচ্চ রান

২৪ রান – জাকের আলী অনিক। আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। 
২০ রান – মাশরাফি বিন মর্তুজা। প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড। ২০০৯ (টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ) 
২০ রান – ইয়াসির আলী রাব্বি। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। ২০২২ সাল। 

প্রসঙ্গত, সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ যথাক্রমে- ৭ ও ২৭ রানে জিতেছিলো বাংলাদেশ। আজ সিরিজের শেষ ম্যাচে সেন্ট ভিনসেন্টে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ১৮৯ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় বাংলাদেশ। দলের হয়ে ৪১ বলে সর্বোচ্চ অপরাজিত ৭২ রান করেন জাকের আলি। জবাবে খেলতে নেমে ১৬ ওভার ৪ বলে ১০৯ রানে অলআউট হয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *