■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমার সময় আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগামী ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আজ মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে। এর আগে গত ১৭ নভেম্বর আরেক আদেশে ৩১ নভেম্বর থেকে সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছিল।
আরেক আদেশে কোম্পানির রিটার্ন জমার সময়ও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগামী ২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানির রিটার্ন দেওয়া যাবে। সাধারণত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানি করদাতারা রিটার্ন দিতে পারে।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ করবর্ষের জন্য কোম্পানি ছাড়া সব শ্রেণির করদাতার আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন ছিল আগামী ৩১ ডিসেম্বর। আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বৃদ্ধির ফলে অনলাইন ও অফলাইন উভয় প্রকার রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে কোম্পানি ছাড়া সব করদাতার জন্য জরিমানা ছাড়া আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
জানা গেছে, জুলাই-আগস্টে আন্দোলন, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন কারণে সময় বাড়ানো হয়েছে।
বিধান অনুযায়ী বছরে আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হলে আয়কর প্রযোজ্য হয়। ব্যাংক হিসাব খোলা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারসহ বেশ কিছু কাজে এখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
রিটার্ন জমা দিলে ব্যাংকে সঞ্চয়ে সুদ বা মুনাফা এবং পুঁজিবাজারে লভ্যাংশের ওপর আয়কর ১৫ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ হয়।
আয়কর রিটার্ন দাখিলে যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন
এনবিআর ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের আয়কর নির্দেশিকা অনুসারে মোট ২২ কারণে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। আর আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে একজন করদাতাকে পেশা অনুসারে বিভিন্ন তথ্য ও দলিল সংযুক্ত করতে হয়। সরকারি-বেসরকারি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ী যে পেশার ব্যক্তিই হোক না কেন করদাতা হিসেবে তাকে আট ধরনের কাগজপত্র রিটার্ন ফরমের সঙ্গে যুক্ত করে দাখিল করতে হবে।
আয়কর রিটার্ন ফরমের সাথে যেসব তথ্য ও দলিলাদি দাখিল করতে হবে তা হলো-
বেতন ভাতা
করদাতা যদি সরকারি বা বেসরকারি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হন তাহলে তাকে যেসব নথিপত্র সংযুক্ত করতে হবে তা হলো-
ক. বেতন বিবরণী,
খ. ব্যাংক হিসাব থাকলে কিংবা ব্যাংক সুদ খাতে আয় থাকলে ব্যাংক বিবরণী বা ব্যাংক সার্টিফিকেট,
গ. বিনিয়োগ ভাতা দাবি থাকলে তার স্বপক্ষে প্রমাণাদি। যেমন- জীবন বিমার পলিসি থাকলে প্রিমিয়াম পরিশোধের প্রমাণ।
নিরাপত্তা জামানতের সুদ খাত
ক. বন্ড বা ডিবেঞ্চার যে বছরে কেনা হয় সে বন্ড বা ডিবেঞ্চারের ফটোকপি,
খ. সুদ আয় থাকলে সুদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নপত্র,
গ. প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে বন্ড বা ডিবেঞ্চার কেনা হয়ে থাকলে ঋণের সুদের সমর্থনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট বা ব্যাংক বিবরণী বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্যয়নপত্র রিটার্নের সঙ্গে জমা দিতে হবে।
গৃহ-সম্পত্তি খাতে যে সব নথিপত্র প্রয়োজন
ক. বাড়িভাড়ার সমর্থনে ভাড়ার চুক্তিনামা বা ভাড়ার রশিদের কপি, মাসভিত্তিক বাড়িভাড়া প্রাপ্তির বিবরণ এবং প্রাপ্ত বাড়িভাড়া জমা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব বিবরণী;
খ. পৌর কর, সিটি করপোরেশন কর, ভূমি রাজস্ব প্রদানের সমর্থনে রশিদের কপি;
গ. ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে বাড়ি কেনা বা নির্মাণ করা হয়ে থাকলে ঋণের সুদের সমর্থনে ব্যাংক বিবরণী ও সার্টিফিকেট এবং
ঘ. গৃহ-সম্পত্তি বিমাকৃত হলে বিমা প্রিমিয়ামের রশিদের কপি রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
ব্যবসা বা অন্যান্য পেশা খাত
ব্যবসা বা অন্যান্য পেশার আয়-ব্যয়ের বিবরণী ও স্থিতিপত্র আয়কর রিটার্নের সঙ্গে জমা দিতে হবে।
অংশীদারি ফার্মের আয়
অংশীদারি ফার্মের ব্যবসা থাকলে ফার্মের আয়-ব্যয়ের বিবরণী ও স্থিতিপত্র জমা দিতে হবে।
মূলধনী লাভ
ক. স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় কিংবা হস্তান্তর হলে তার দলিলের কপি;
খ. উৎসে আয়কর জমা হলে তার চালান বা পে-অর্ডারের ফটোকপি এবং
গ. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার লেনদেন থেকে মুনাফা হলে এ সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র রিটার্নে সঙ্গে জমা দিতে হবে।
অন্যান্য উৎসের আয়ের খাত
ক. নগদ লভ্যাংশ খাতে আয় থাকলে ব্যাংক বিবরণী, ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্টের কপি বা সার্টিফিকেট;
খ. সঞ্চয়পত্র হতে সুদ আয় থাকলে সঞ্চয়পত্র নগদায়নের সময় বা সুদ প্রাপ্তির সময় নেওয়া সার্টিফিকেটের কপি;
গ. ব্যাংক সুদ আয় থাকলে ব্যাংক বিবরণী কিংবা সার্টিফিকেট;
ঘ. অন্য যেকোনো আয়ের উৎসের জন্য প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র।
আয়কর পরিশোধের প্রমাণ (উৎসে কর কর্তনসহ)
করদাতা যদি উৎসে কর কিংবা কর ই-পেমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করেন তাহলে রিটার্ন দাখিলের সময় তার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। যেমন-
ক. সকল প্রকার উৎসে কর পরিশোধ অটোমেটেড চালান (এ-চালান) বা ই-পেমেন্টের মাধ্যমে জমা করতে হবে;
খ. করদায় ৫ লাখ টাকা অতিক্রম না করলে তা আবশ্যিকভাবে অটোমেটেড চালান (এ চালান) বা ই-পেমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে;
গ. ৫ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে যেকোনো পরিমাণের কর অটোমেটেড চালান, ই-পেমেন্টে, পে অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফট/একাউন্ট-পেয়ী চেক ব্যবহার করে উপ-কর কমিশনার বরাবর জমা করতে হবে।
ঘ. যেকোনো খাতের আয়ে উৎসে কর পরিশোধ করা হয়ে থাকলে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষ যে চালান বা ই-পেমেন্টের চালানসহ প্রত্যয়নপত্র করদাতাকে দিয়েছে তা রিটার্ন ফরমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
ই-রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক যাদের
চার সিটি কর্পোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলের অধিভুক্ত সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকার, মোবাইল প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও ছয়টি বড় কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) এক বিশেষ আদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ কথা জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ এ মু’মেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে রিটার্ন দাখিলসংক্রান্ত এনবিআরের বিশেষ আদেশে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের আয়কর আইনের ক্ষমতাবলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চার ধরনের ব্যক্তি করদাতাদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে আয়কর দাখিল বাধ্যতামূলক করল।
তালিকার প্রথমে রয়েছেন ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলগুলোর অধিক্ষেত্রভুক্ত সব সরকারি কর্মচারী। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন সব তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তৃতীয়ত, দেশের সব মোবাইল টেলিকম সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরও অনলাইনে রিটার্ন দিতে হবে।
এছাড়া ছয়টি বড় বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এই কোম্পানিগুলো হলো ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি।
সৈয়দ এ মুমেন বলেন, ২০২৪-২০২৫ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ পদ্ধতি সহজীকরণের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে করদাতাদের জন্য অনলাইন রিটার্ন দাখিল সিস্টেম উন্মুক্ত করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের www.etaxnbr.gov.bd ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা সহজে নিজের রিটার্ন তৈরি করে অনলাইনে দাখিল করতে পারছেন। করদাতারা এ সিস্টেম থেকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট (ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড) ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কর পরিশোধ করতে পারছেন এবং দাখিল করা রিটার্নের কপি, প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, আয়কর সনদ, টিআইএন সনদ ডাউনলোড ও প্রিন্টের সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়া পূর্ববর্তী বছরের দাখিল করা ই- রিটার্ন ডাউনলোড ও প্রিন্ট করতে পারছেন।
তিনি বলেন, ই-রিটার্ন সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় করদাতাদের সহায়তা প্রদানের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি কল সেন্টার স্থাপন করেছে। এরইমধ্যে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ১ লাখ অতিক্রম করেছে।