:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বেঁধে দেয়া সময়ের একদিন আগেই আজ অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে অভিযান চালিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এতে শতাধিক অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শনিবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন সাংবাদিকদের জানান, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। ৭২ ঘণ্টা শেষ হলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বসবেন। নিবন্ধনের কতটা অগ্রগতি হয়েছে, অবৈধ কতগুলো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ হয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করা হবে। এরপর সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী- বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তাদের সঙ্গে বসে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডা. বেলাল হোসেন বলেন, সারা দেশে কতগুলো অবৈধ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। কারণ যারা অবৈধভাবে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার দিয়েছে, তাদের সংখ্যাটা বলা যাচ্ছে না। যারা আবেদনই করেনি, তাদের তথ্য আমরা জানব কী করে?
অধিদপ্তরের পরিচালক জানান, অবৈধগুলোর নির্দিষ্ট তালিকা না থাকলেও বৈধদের তালিকা জেলা সিভিল সার্জনদের কাছে রয়েছে। সে অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের মনিটরিং এবং সুপারভিশন নিয়ে গত ২৪ মে বিকালে ভার্চুয়ালি এক সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের পরই দেশের সব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশের পর সারা দেশে অভিযান শুরু করে প্রশাসন। প্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি করা হচ্ছে জরিমানা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করায় চট্টগ্রামের চারটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন ইলিয়াস চৌধুরীর নেতৃত্বে শনিবার দুপুরে অভিযান চালিয়ে এগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
ওই চার প্রতিষ্ঠান হলো চট্টেশ্বরী এলাকার কসমোপলিটন হাসপাতাল, ডিটি রোডের পপুলার মেডিক্যাল সেন্টার ও ক্লিনিক্যাল ল্যাব, পাঁচলাইশ এলাকার সিএসটিসি হাসপাতাল এবং ওয়াসা মোড়ের নিরুপণী ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
সিভিল সার্জন বলেন, ‘ছয়টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চারটি মৌখিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো লাইসেন্স দেখাতে পারেনি। বাকি দুটির সেবার মূল্য তালিকা নেই। এদের সতর্ক করে মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’
টাঙ্গাইল সদরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রানুয়ারা খাতুনের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তিনটি ক্লিনিক সিলগালা ও এর মালিকদের জরিমানা করা হয়েছে।
ওই তিন ক্লিনিক হলো স্বদেশ ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পদ্মা ক্লিনিক ও আমানত ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটাল। এ ছাড়া ডিজিল্যাব নামের আরেকটি ক্লিনিকে সিজারিয়ান রোগী থাকায় রোববার দুপুর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে দ্য সিটি ক্লিনিককে ২০ হাজার টাকা, কমফোর্ট হাসপাতালকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ইউএনও রানুয়ারা বলেন, ‘কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তিনটি ক্লিনিককে সিলগালা ও মালিকদের জরিমানা করা হয়েছে। ডিজিল্যাবেরও বৈধ কাগজ নেই। তবে সেখানে সিজারিয়ান রোগী থাকায় রবিবার দুপুরের পর সিলগালা করা হবে।’
চুয়াডাঙ্গা সদরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আওলিয়ার রহমানের নেতৃত্বে চালানো অভিযানে তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা ও দুইটি মৌখিকভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সদর হাসপাতাল সড়ক এলাকায় এই অভিযান চালানো হয়।
আওলিয়ার বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় ২৫টি ক্লিনিক ও প্যাথলজি চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হচ্ছে। তার মধ্যে আজকে সদর হাসপাতাল সড়কের বেশ কিছু ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে অভিযান চালানো হয়। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হয়েছে। এগুলো হলো- সেন্ট্রাল মেডিক্যাল সেন্টার, আমাদের সনো এবং চুয়াডাঙ্গা আলট্রাসনোগ্রাফি সেন্টার। এ ছাড়া ইসলামী হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক বিভাগ ও তিশা ডায়াগনস্টিক সেন্টার মৌখিকভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
নাটোরে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে সাতটি অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল সিলগালা করেছে। সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়।
সিলগালা করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো শহরের মাদ্রাসা মোড় এলাকার পদ্মা ক্লিনিক, সেন্ট্রাল ল্যাব ও প্রাইম ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চকরামপুরের হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চকবৈদ্যনাথের মদিনা চক্ষু হাসপাতাল, হাফরাস্তার তামান্না ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং বড়হরিশপুরের বরাত ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
মাহবুবুর রহমান বলেন, জেলায় ১৭০টি ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংক আছে। এগুলোর মধ্যে অনিবন্ধিত সাতটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে সিলগালা করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বন্ধ করে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের দাবি, তারা নিবন্ধনের জন্য দেড় বছর আগে অনলাইনে আবেদন করে টাকা ও কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। এখনও নিবন্ধন নম্বর পাননি।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে সিভিল সার্জন আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে পাঁচটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে একটি ক্লিনিককে। খোকসা উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ১১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে টাস্কফোর্সের সদস্যরা। নিবন্ধন নবায়ন না করায় সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় ১৫০টি বৈধ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে। এর বাইরে অবৈধগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। প্রত্যন্ত এলাকাতেও অবৈধ প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোতেও অভিযান চালানো হবে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। সেই পরিমাণ জনবল স্বাস্থ্য বিভাগের নেই।’
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে লাইসেন্স না থাকায় দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আম্বিয়া সুলতানার নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়।
সিলগালা করা প্রতিষ্ঠান দুটি হলো বালিয়াকান্দি হাসপাতাল রোডের অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চন্দনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড ডাক্তার চেম্বার।
ইউএনও আম্বিয়া বলেন, ‘আমরা আজকে অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে অভিযান চালাই। এ সময় দুইটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাদের বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এ কারণে এগুলো সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।’
মাগুরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ১৫টি অনিবন্ধিত ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন মো. শহীদুল্লাহ দেওয়ানের নেতৃত্বে শহরের ভায়না, সরকারি কলেজ রোড, ঢাকা রোড, নতুন বাজার, স্টেডিয়াম গেটসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়।
সিভিল সার্জন বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে সারা দেশের মতো মাগুরাতেও অবৈধ প্রাইভেট হাসপাতালের তালিকা করে অভিযান চালানো হচ্ছে। আমাদের কাছে কয়েক বছর আগের ডেটা ছিল। সে অনুযায়ী মাগুরায় প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের সংখ্যা ১৪১টি। এখন মাঠে নেমে দেখি অনেক জায়গায় গোপনে হাসপাতাল, ক্লিনিকের হাট বসেছে। নিবন্ধন না থাকলেই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় সারা দেশের মতো শেরপুরেও অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
আজ জেলা সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ২৬টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২৮টি ক্লিনিক ও ১১১টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করায় অনেক মালিকপক্ষ লাইসেন্স নবায়ন করেনি।
সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য জানান, ইতোমধ্যে যেসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নেই, সেগুলো আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে মালিকরা যদি শর্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজ প্রস্তুত করে ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন করেন, তাহলে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেব।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (২৫ মে) অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর মনিটরিং ও সুপারভিশন বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিদ্ধান্তগুলো হলো
১. আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করতে হবে। অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। এ কার্যক্রমে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
২. যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে কিন্তু নবায়ন করেনি, তাদের নিবন্ধন নবায়নের জন্য একটি সময়সীমা দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নবায়ন না করলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
৩. বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপারেশন করার সময় অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া ও ওটি অ্যাসিস্ট করার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ডাক্তার ছাড়া অন্যদের রাখা হলে সেসব প্রতিষ্ঠান ও জড়িতদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. যেসব প্রতিষ্ঠান নতুন নিবন্ধনের আবেদন করেছে, তাদের লাইসেন্স দেওয়ার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হবে। লাইসেন্স পাওয়ার আগে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারবে না।
উল্লেখ্য, অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে অনুমোদিত ও আবেদন করা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।