১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নিতে রাজি মিয়ানমার

■ কূটনৈতিক প্রতিবেদক ■ 

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রত্যাবর্তনের যোগ্য ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রথম ধাপে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে তারা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০১৮-২০ সালের মধ্যে ছয় ধাপে এ সংক্রান্ত মূল তালিকা সরবরাহ করা হয়েছিল।

এখনো ৭০ হাজার রোহিঙ্গার ছবি ও নাম অতিরিক্ত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) ব্যাংককে ৬ষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এক বৈঠকে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শোয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে এ তথ্য জানান।

এটি রোহিঙ্গাদের ফেরানো ক্ষেত্রে প্রথম এই ধরনের নিশ্চিত তালিকা, যা রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, মূল তালিকায় থাকা অবশিষ্ট ৫ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা হবে।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি মিয়ানমারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়াও তিনি বলেন, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল।

এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে যায়। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা।

এর মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনা কমে আসে। উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়।

এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে নেপিদোর সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটা পড়ে ঢাকার।

এর মধ্যে গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কষ্ট নিজের চোখে দেখেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে তিনি সেদিন ইফতারও করেন।

প্রত্যাবাসনই যে রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান, সে কথা তুলে ধরে জাতিসংঘ প্রধান সেদিন বলেন, “শেষমেষ মিয়ানমারেই সমাধান পেতে হবে আমাদের। এখানে থাকা সব শরণার্থীর স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।”

সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে আশার আলো জ্বালান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি ছুটে যান কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। দিনভর সেখানে কাটান। সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ছিলেন। তারা এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে ইফতারও করেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন প্রত্যাশার কথা জানান। রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথাও তুলে ধরেন।

একই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন আশার কথা শোনান। তিনি জানান, বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আশা করছেন, আগামী রোজার ঈদ রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে করতে পারবেন। তাদের এই বক্তব্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। সেই আশা আরও জোরালো করল মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নতুন আশ্বাস। 

সেখানে ড. ইউনূস পরের ঈদটি যেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নিজ ভূমিতে ফিরে করতে পারেন, সেজন্য নিজের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন এবং এজন্য তাদের কাছে দোয়াও চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর হাছে দোয়া গরি, সামনর ঈদত যেন অনারা নিজর বাড়িত যাইয়েরে ঈদ গরিন ফারন। ’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *