:: মোহাম্মাদ আলী এফসিএ ::
দেশে মোটামুটি সচ্ছলতায় দিনগুলো ভালই কাটছিল। কিসের যেন মোহে সব ছেড়ে চলে এলাম। শুরু হলো নতুন জীবন সংগ্রাম। শ্যালকের এক বাসায় উঠেছি। শুনেছি তিনি একজন মিলিয়নেয়ার ব্যবসায়ী। গ্যাস (তেল) স্টেশনের মালিক। ব্যবসার কাছাকাছি তার আর ও একটা বাসা।
সেখানেই সে বেশি সময় কাটায়। সপ্তাহে একবার বাজার সদাই নিয়ে এ বাড়ি আসে। আর আমরা বসে বসে খাই আর ঘুমাই। অতি প্রত্যন্ত অঞ্চল। অনেক দুরে দুরে ঘরবাড়ি। গাড়ি ছাড়া কোথাও যাবার উপায় নেই। সপ্তাহ পার না হতেই আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। ছেলেমেয়েকে নিয়ে আরেক সমস্যা। ছেলের স্কুল কাছে। তবে গাড়ি ছাড়া চলবে না। অবশ্য স্কুলবাসে ও যাওয়া যায়।
মেয়ের কলেজ পঞ্চাশ মাইল দুরে। তাকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে। কোনো কাজে যেতে আমার ও গাড়ি লাগবে। অন্তত দুটি গাড়ি না হলে চলবে না। যদিও বাংলাদেশে সবাই ড্রাইভিং শিখেছি। কিন্তু এখানকার লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি ড্রাইভ করা অসম্ভব। প্রথমে পরিক্ষা দিয়ে learner license নিতে হবে। তারপর ড্রাইভিং টেস্ট দিয়ে লাইসেন্স পেলে তবেই গাড়ি চালানো যাবে। আমার learner license পূর্বেই ছিল। তাই ড্রাইভিং টেস্ট দিলেই লাইসেন্স পেয়ে যাব। তবে learner license দিয়ে ড্রাইভ করতে ও পাশে licensed ড্রাইভার থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত নেই আমার license টা পেলে গাড়ি কিনব। একটা গাড়ি হলেও ছেলেমেয়ের স্কুল/কলেজ চলবে। সমস্যা হলো ড্রাইভিং টেস্ট দিতে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। শ্যালক ও তার স্ত্রীর কোনো সময় নেই। তারা এক ঘন্টা সময় দিতে ও অপরাগ। অথচ ছেলে মেয়ের স্কুল ঠিকই চলছে। এখানে যাচ্ছে সেখানে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাদের একটা সমস্যায় ফেলেছি। দেখতে দেখতে ৩ মাস পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে আমার মেয়েকে তাদের দোকানে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে দোকানে কাজ করছে। সপ্তাহে একদিন আমাদের কাছে আসে। বুঝতে পারছি দিনগুলো খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন বাসায় শুয়ে বসে সময় যায়। কোথায় ও বের হবার সুযোগ নেই। বাসা থেকে মেইন রোড অনেক দুর। একদিন হাটতে হাটতে রউনা দিলাম।
রাস্তার সাথেই দু একটা বাড়ি। কোন বাড়ির সামনে এলেই পোষা কুকুরের হাকডাকে পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। রাস্তা থেকে শক্ত একটা গাছের ঢাল হাতে নিয়ে চলতে থাকি। এভাবে ঘন্টা খানেক পর মেইন রোড পেলাম। মাঝে মাঝে দুএকটা দোকান। একটা গ্যাস স্টেশনে প্রবেশ করি। টেলিফোনে একটা ছেলে কথা বলছে। মনে হলো বাংলা বলছে। জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হই সে বাংলাদেশি। অনেক কথা হয় তার সাথে। অনেক আন্তরিক ছেলেটা। এরপর মাঝে মাঝেই তার ওখানে যেয়ে সময় কাটাই। একদিন কথা প্রসঙ্গে আমার ড্রাইভিং এর সমস্যা বলি। আমার কথা শুনে বলে আমি আপনাকে নিয়ে যাব ভাই। কি আশ্চর্য নিজের লোকের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। দুদিনের পরিচয়ে ছেলেটির সহমর্মিতা সত্যিই ভুলার নয়। দুদিন পর তার ছুটি। আমার ঠিকানা নিয়ে বলল সকালে রেডি থাকতে। যথা সময়ে আমাকে নিয়ে যায়। ইন্সট্রাকটর শুধু চাবি দিয়ে বলল lets go. ছেলেটা কিছু টিপস দিয়েছিল। স্টার্ট দিয়ে সব চেক করে চালাচ্ছি। শুধু কোন দিকে যাব তার নির্দেশ দিচ্ছে। বিভিন্ন Road Sign মেনে চলছি। এরপর পার্কিংয়ে এসে পার্ক করতে বলে। পার্কিং শেষে আবার lets go again. এবার একটা লম্বা রাস্তায় এসে থামতে বলে। বলে ৩০ মাইল বেগ নিয়ে হঠাৎ Completed Stop করতে। গাড়ি stop হলে হাসি মুখে congratulate করে। সুতরাং পাস ও লাইসেন্স পেয়ে যাই। আমার হাসি মুখে বের হতে দেখেই
অভিনন্দন জানায়। সহযোগিতা করতে পেরে ছেলেটা ও অনেক খুশি। এইভাবে আমেরিকার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যাই।
একটা গাড়ি কেনা একান্ত জরুরি। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু ডলার নিয়ে এসেছি। অন্তত ছয় মাস যাতে চলা যায়। সপ্তাহান্তে শ্যালক সাহেব আসলে গাড়ি কেনার কথা বলি। লাইসেন্স পেয়েছি শুনে অবাকই হলো। যাহোক সকলে মিলে গাড়ি দেখতে যাই। অনেক দেখাদেখি শেষে একটা নুতন গাড়ি পছন্দ হলো। নগদে ক্রয় করলে হাতে তেমন কিছু থাকে না। শ্যালক সাহেবকে বলি অর্ধেক নগদে আর অর্ধেক লোনে নেয়া যায় কিনা। আমার কোনো আয় নেই।
কোনো ক্রেডিট হিস্ট্রি নেই। তাই আমাকে কোনো লোন দেবে না। তবে কেউ আমার সাথে co-signer হলে লোন পাওয়া যাবে। বিষয়টি আমি পুর্বে শুনেছি। শ্যালক সাহেবকে বললাম আমার সাথে co-sign দিতে। অনেক গড়িমসির পর co-sign করে। দুজনের নামে লোন অনুমোদিত হলো। এখানে গাড়ি পছন্দ হলে গাড়ি টেস্টের জন্য কিছু সময় দেয়। বিক্রেতা বলল গাড়ি নিয়ে যেতে। পছন্দ হলে পরের দিন লেনদেন সম্পন্ন করতে। ছেলেমেয়ের খুশি দেখে কে।
সবাইকে নিয়ে পঞ্চাশ মাইল ড্রাইভ করে বাসায় যাচ্ছি। আমেরিকার রাস্তায় প্রথম ড্রাইভিং। খুবই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। যার যার লেন দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। ওভারটেকের বালাই নেই। কোনো হর্নের প্রয়োজন নেই। খুবই ঝামেলামুক্ত ও আনন্দময় ড্রাইভিং। গাড়ির ব্যবস্থা হওয়াতে একটা আশার আলো দেখছি। পরের দিন লেনদেন সম্পন্ন করতে ডিলারশীপে যাই। কিন্তু শ্যালক সাহেবের দেখা নাই। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছি। পরে বিক্রেতাকে বলি শ্যালক সাহেবকে ফোন দিতে। সারাদিন অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় তার দেখা মিলল। কিন্তু সে co-sign করতে পারবে না। কারণ আমার কোনো আয় নেই। যদি আমি মাসিক কিস্তি চালাতে না পারি, তাকেই দায় নিতে হবে। এই রিস্ক সে নিতে পারবে না। তাই গাড়ির সপ্ন ভেঙ্গে যায়। কি আর করা। সবাই মন খারাপ করে তার বাসায় যাই। সেখানে যেয়ে বুঝতে পারি আমাদের নিয়ে তাদের অনেক সমস্যা।
আমাদের সংসার কিভাবে চলবে। কিভাবে বাড়ি ভাড়া হবে, কিভাবে অন্যান্য খরচ চলবে। সে হিসেব কসতে বসল। বাড়ি ভাড়া, খাবার , গাড়ির পেয়েমেন্ট , ইন্সুরেন্স, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিবিধ মিলে মাসে ২০০০ ডলার। কিভাবে আসবে এত ডলার। বললাম তোমার তো দোকান আছে। সেখানে আমার মেয়ে কাজ করছে। তাকে মাসে একটা বেতন দেবে তো। বলে তার একার বেতনে হবে না। বলি আমার কাছে কয়েক মাস চলার ব্যবস্থা আছে। হয়তো আমি ও একটা কিছু করব। তাছাড়া তোমার বোনকে ও দোকানের কাজে লাগাতে পার। বলে সে কিছুই করতে পারবে না। সারাজীবন নিজে চলার চেষ্টা করেছি। শত অভাব অনটনের মধ্যেও কার সাহায্য নেই নি। কোনদিন কারো মুখাপেক্ষি হইনি। তার কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আত্নসম্মানে এতোই বাধল যে এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। কথা না বাড়িয়ে বললাম ঠিক আছে। কাল ভোরে আমরা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি। আমার কথায় মনে হলো তারা খুশি। সাউথ ফ্লোরিডায় মামা শ্বশুরের ছেলে থাকত। তার সাথে আগ থেকেই যোগাযোগ ছিল। তার সাথে যোগাযোগ করলে বলে চলে আসেন। সাথে সাথে অনলাইনে বাসের টিকিট নেই। আত্মীয়কে বললাম আমাদেরকে আগের বাসায় দিয়ে আসতে। সেখানে সারারাত ব্যাগেজ গুছিয়ে রেডি থাকি। সকালে শ্যালক স্ত্রী বাস স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যায়। ৮০০ মাইল বাসে ভ্রমণ শেষে সাউথ ফ্লোরিডা পৌছাই। পিছনে রেখে এলাম আত্মীয়তার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। (চলবে)।
ফ্লোরিডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে