চীন বাদে সব দেশের ওপর নতুন শুল্ক স্থগিত করলেন ট্রাম্প

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

চীন বাদে যেসব দেশের ওপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল সেটি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

বুধবার (৯ এপ্রিল) অন্য দেশগুলোকে ছাড় দিলেও চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্কের পরিমাণ ১০৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

বাংলাদেশের ওপর গত সপ্তাহে পারস্পরিক শুল্ক হিসেবে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন তিনি।

নিজের মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম ট্রুথে এ ব্যাপারে ট্রাম্প লিখেছেন, “বিশ্ববাজারের প্রতি চীন যে অসম্মান দেখিয়েছে, সেটির ভিত্তিতে আমি চীনের ওপর শুল্কের পরিমাণ ১২৫ শতাংশে উন্নীত করছি। যা এ মুহূর্ত থেকে কার্যকর হবে।”

“একটা সময়ে, আশা করি দ্রুত চীন বুঝতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশকে ‘শোষন’ করার সময় বিষয়টি আর মানা হবে না।”- যোগ করেন ট্রাম্প।

অন্যান্য দেশগুলোর ওপর আরোপ করা পারস্পরিক শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করার বিষয়টি জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, “বিপরীতভাবে, ৭৫টিরও বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের বাণিজ্য, বাণিজ্য বাধা, শুল্ক, মুদ্রা জালিয়াতি, অ-আর্থিক শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকেছে। এবং এই দেশগুলো আমার শক্তিশালী পরামর্শের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের জন্য আমি শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছি এবং পারস্পরিক শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। বিষয়টিতে মনযোগ দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।”

তবে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য সরবরাহে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। সেই সুযোগ রাখা হয়নি। বিশ্বের সব দেশকে নূন্যতম ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিনিদের কাছে পণ্য পাঠাতে হবে। বাংলাদেশি পণ্যে আগে থেকেই গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল।

গত বুধবার রোজ গার্ডেনে বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যের ওপর ‘রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ বা পারস্পরিক শুল্ক ঘোষণা করেন ট্রাম্প। এরপরই বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। চীনের বাইরে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ। এগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ায় ৪৯ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপিত হয়েছে, যা এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩২ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১৭ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ ওপরও আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১০৪ শতাংশ শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার (৯ এপ্রিল) এশিয়ার শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হতে হতেই বড় ধরনের রদবদল হয়। শুরু হয় পতন। এরপর ইউরোপের শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার পরপরই সূচকের পতন হয়। 

আঞ্চলিক স্বাস্থ্যসেবা, খনি ও তেল ও গ্যাস খাতের সূচকগুলো ব্যাপক হারে পড়ে গেছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা, খনি, তেল ও গ্যাস খাতের শেয়ারের দাম যথাক্রমে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।

সেই সঙ্গে দাম কমেছে জ্বালানি তেলের। চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম নেমে এসেছে ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। দর কমেছে ডলারের। সব মিলিয়ে মন্দার আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ভারতের এনডিটিভির সংবাদে নতুন কিছু খাতে শুল্ক আরোপের তথ্য দেওয়া হয়েছে। ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের আওতার বাইরে কিছু খাত রয়ে গেছে, যেমন ওষুধ ও সেমিকন্ডাক্টর। তবে তারাও বেশি দিন আওতার বাইরে থাকতে পারবে না। সংবাদে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প শিগগিরই ওষুধ খাতে বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করতে পারেন। সেই শুল্কবানে রীতিমতো ক্ষতবিক্ষত হতে পারে ভারতের ওষুধ শিল্প। এরই মধ্যে তার একটা ইঙ্গিতও দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

গত মঙ্গলবার ন্যাশনাল রিপাবলিকান কংগ্রেশনাল কমিটির সভায় ট্রাম্প বলেন, এমনভাবে ওষুধ শিল্পে শুল্ক আরোপ করা হবে যে কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে।

ভারতের ওষুধ রপ্তানির মূল বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত যত ওষুধ রপ্তানি করেছে, তার ৩১ শতাংশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রে; অর্থের পরিমাণের দিক থেকে যা ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৮৭০ কোটি ডলার।

বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘটনায় শুরু থেকেই যুদ্ধংদেহী ছিল চীন। ২ এপ্রিলের পর চীনও মার্কিন পণ্যে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করে। এরপর ট্রাম্প আরও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন চীনের পণ্যে। সব মিলিয়ে চীনের পণ্যে অতিরিক্ত ১০৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে চীন জানিয়েছে, এই দ্বন্দ্ব সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক। যদিও তারা একই সঙ্গে বলেছে, এই বাণিজ্য ঘাটতি অনিবার্য ও কাঠামোগত বিষয়। ট্রাম্প চীনকে এ রকম আঘাত করতে থাকলেও বা পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করতে চাইলে তারাও প্রস্তুত। সে কারণে তারাও আবার ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।

বুধবার চীন বাণিজ্য বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছে, চীন সব সময়ই চেষ্টা করেছে মার্কিন-চীন বাণিজ্য যেন সব সময় উভয়ের জন্য লাভজনক হয়। শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পাল্টা শুল্কে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ইউরোপ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটছে। গতকাল বুধবার ইউরোপের নেতারা ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের জবাবে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্য সমন্বয় করে ইউরোপীয় কমিশন। তারা বিভিন্ন ধরনের মার্কিন পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে, যেমন মোটরসাইকেল, মুরগি, ফলমূল, কাঠ, পোশাক ও ডেন্টাল ফ্লস। এ-সংক্রান্ত একটি নথি রয়টার্সের হাতে এসেছে।

ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের যে প্রভাব ইউরো অঞ্চলে পড়বে বলে আগে হিসাব করা হয়েছিল, এখন তারা মনে করছে, প্রভাব তার চেয়ে বেশি হবে। বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত চারটি সূত্র রয়টার্সকে এ তথ্য দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থায়ন সচল রেখে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা হবে বলে জানিয়েছে।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এই যখন পরিস্থিতি, তখনও কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্ভার। মঙ্গলবার তিনি বলেছিলেন, সমস্যা সারাতে ওষুধ দিতে হয়। তিনি সেই ওষুধ দিয়েছেন। এরপর কিছু ওলটপালট হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট বা সরকারপ্রধানরা যেভাবে তাকে ফোন করছেন, তাতে ট্রাম্প বেশ খুশি, বিষয়টি তিনি উপভোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বনেতারা এখন আমাকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করছেন। তাঁরা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে মরিয়া।’ স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প এ মন্তব্য করেন। ট্রাম্প বলেন, ‘এসব দেশের নেতারা আমাদের ফোন করছেন। আমার পশ্চাদ্দেশে চুমু খাচ্ছেন। চুক্তি করার জন্য তাঁরা মরিয়া হয়ে পড়েছেন।’

নতুন শুল্ক স্থগিত করায় ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

বেশিরভাগ দেশের ওপর ৯০ দিনের জন্য শুল্ক আরোপ থেকে সরে আসার ঘোষণার পরপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এক্স-এ (পূর্বের টুইটার) একটি পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টকে মেনশন করে প্রধান উপদেষ্টা লিখেছেন, ‘শুল্ক স্থগিতের জন্য আমাদের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, মি. প্রেসিডেন্ট।’

পোস্টটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আপনার [ট্রাম্প] বাণিজ্য এজেন্ডাকে সমর্থন জানিয়ে আমরা [বাংলাদেশ] আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *