■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৭ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) অনন্তনাগ বিভাগের পাহালগামে এ হামলা হয়।
সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, যেখানে হামলা হয়েছে সেটি একটি বিস্তৃত তৃণভূমি। ওই স্থানটিতে শুধুমাত্র ঘোড়া অথবা পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। মঙ্গলবার সকালে সেখানে পর্যটকদের একটি দল গিয়েছিল। ওই সময় তাদের ওপর হামলা হয়।
জম্মু-কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, নিহতের সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, “বেসামরিকদের ওপর এখন পর্যন্ত আমরা যেসব হামলা দেখেছি সেগুলোর তুলনায় এটি অনেক বড়।”
এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং তাকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর অমিত শাহ ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে তিনি একটি জরুরি বৈঠকে বসবেন।
বার্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, হামলাস্থল ছিল পাহালগামের বৈসারান তৃণভূমিতে। সেখানে একটি রিসোর্টের কাছে হামলার পর অনেকের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
এনডিটিভি জানিয়েছে, হামলায় আহতদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছে। টেলিফোনে কথোপকথনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে হামলাস্থল পরিদর্শন করতে এবং সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শিগগিরই সকল সংস্থার সাথে একটি জরুরি নিরাপত্তা পর্যালোচনা বৈঠক করার জন্য শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা হবেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাহালগাম বৈসরান ভ্যালির উপরের মাঠে গুলির শব্দ শোনা গেছে। এলাকাটি শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে পৌঁছানো যায়। সন্ত্রাসীরা সাধারণ পোশাকে মানুষের সঙ্গে মিশে ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এটি একটি টার্গেটেড হামলা বলেই মনে করা হচ্ছে।
হামলার পরপরই দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাসভবনে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে গোয়েন্দা ব্যুরোর প্রধান তপন যেকা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ মোহন উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সিআরপিএফ প্রধান জ্ঞানেন্দ্র প্রতাপ সিংহ, জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিজি নলিন প্রভাত এবং কিছু সেনা কর্মকর্তাও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহার সঙ্গেও কথা বলেছেন অমিত শাহ।
লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা জানান, সন্ত্রাসীদের ধরতে বিরাট সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান শুরু করা হয়েছে। পাহালগামে হামলাকারীদের তাদের জঘন্য কাজের কঠিন মূল্য দিতে হবেবলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
বার্তাসংস্থাটি আরও জানিয়েছে, ভারী অস্ত্রেসস্ত্রে সজ্জিত অস্ত্রধারীরা পাহাড়ের ওপরের তৃণভূমির গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। তারা ৪০ জনের একটি পর্যটক দলকে ঘিরে ফেলে। এরপর এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অস্ত্রধারীরা যখন গুলি চালানো শুরু করে, তখন স্থানীয়রা, যারা পর্যটকদের কাছে মালামাল বিক্রি করেন, তারা নিরাপদস্থানে সরে যান। এতে শুধুমাত্র পর্যটকরা গোলাগুলির মাঝে পড়েন। তখন তাদের ওপর নির্বিচার গুলি ছোড়া হয়।
পিটিআইকে এক নারী টেলিফোনে বলেছেন, “আমার স্বামীর মাথায় গুলি লেগেছে। এছাড়া আরও সাতজন আহত হয়েছেন।” তিনি সাংবাদিকের কাছে অনুরোধ করে বলেন, “ভাই, দয়া করে আমার স্বামীকে বাঁচান।”
জনপ্রিয় ওই জায়গাটিতে যেহেতু শুধু পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় করে যাওয়া যায়। তাই আহতদের উদ্ধারে ঘটনাস্থলে হেলিকপ্টার পাঠাতে অনুরোধ জানায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
নিহতদের মধ্যে কর্ণাটকের শিভমগ্গার এক ব্যবসায়ী রয়েছেন। নিহত ব্যক্তির পরিবার জানিয়েছে, তার নাম মুঞ্জুনাথ রাও (৪৭)। তিনি স্ত্রী পল্লবী ও ছেলে অভিজয়কে নিয়ে জম্মু-কাশ্মিরে ঘুরতে গিয়েছিলেন।
স্ত্রী পল্লবী ফোনে কর্ণাটকের স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “আমাদের চোখের সামনে আমার স্বামীকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। আমি তাদের আমাকেও হত্যা করতে বলেছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।”
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একে ‘কাপুরুষোচিত ও নিন্দনীয়’ বলে আখ্যা দেন। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতিও পর্যটকদের ওপর এই সহিংসতার তীব্র নিন্দা করে বলেন, ‘কাশ্মীর ঐতিহাসিকভাবে পর্যটকদের সাদর সম্ভাষণ করে। এই বিরল হামলা গভীর উদ্বেগের বিষয়। দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
জানা গেছে, ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটল, যখন উপত্যকায় পর্যটনের মৌসুম চলছে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অমরনাথ যাত্রার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়েছে। দুটি রুটে ৩৮ দিনব্যাপী এই তীর্থযাত্রা শুরু হবে ৩ জুলাই থেকে। এর মধ্যে একটি রুট হলো ৪৮ কিমি দীর্ঘ পাহেলগাম রুট এবং তুলনামূলকভাবে ছোট ও খাড়া ১৪ কিমি বলতাল রুট।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই এলাকায় ১৯৮৯ সাল থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতা হয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কমে আসছিল।
জম্মু–কাশ্মীরে বেশ কয়েক বছর ধরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য ছিল নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী। বহুদিন ধরে সশস্ত্র গোষ্ঠী পর্যটকদের আক্রমণ করেনি। নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়াও সশস্ত্র গোষ্ঠীদের আক্রমণে পরিযায়ী শ্রমিকদের কেউ কেউ নিহত হয়েছিলেন। তবে স্থানীয় মানুষজনের অর্থনীতির স্বার্থে পর্যটকদের ওপর কোনো হামলা হয়নি। ফলে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।
গত বছরের মে মাসে অবশ্য এই পহেলগামেই সশস্ত্র গোষ্ঠীর আক্রমণে আহত হয়েছিলেন দুজন পর্যটক। কিন্তু সরকার এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন মনে করেছিল। আজ মঙ্গলবারের ঘটনার পর মনে করা হচ্ছে, সশস্ত্র গোষ্ঠী সম্ভবত তাদের কৌশল বদল করেছে। এ ঘটনার পর জম্মু–কাশ্মীরে পর্যটন ব্যবসা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জম্মু–কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের পর এত দিন পরিস্থিতি শান্তই ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের সাফল্যের কাহিনি প্রচার করেছে। কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনা বুঝিয়ে দিল, উপদ্রুত উপত্যকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শেষ হয়ে যায়নি।
ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোয়েন্দা প্রধান তপন ডেকা, স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ মোহন বৈঠকে বসেন। এতে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন সিআরপিএফ প্রধান জ্ঞানেন্দ্র প্রতাপ সিং, জম্মু–কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিচালক নলিন প্রভাত এবং সেনাকর্তারা। অমিত শাহ বৈঠক থেকেই কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহার সঙ্গে।