■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে। স্বামীর চেয়ে স্ত্রীরাই বিচ্ছেদ নিচ্ছেন বেশি। ডিএসসিসি রাজস্ব বিভাগের ‘লিপিবদ্ধকৃত বিয়ে ও তালাক নোটিশের হিসাব’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই সিটি করপোরেশন এলাকায় বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৯১৩টি। এর মধ্যে স্বামীর আবেদনে বিচ্ছেদ হয়েছে ২ হাজার ১৪৯টি। বাকি ৫ হাজার ৭৬৪টি (আড়াইগুণের বেশি) বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে স্ত্রীর আবেদনে।
২০২৩ সালে ডিএসসিসিতে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা নথিভুক্ত হয় ৭ হাজার ৩০৬টি। এর মধ্যে স্বামীর আবেদন ছিল ২ হাজার ২০টি এবং স্ত্রীর আবেদন ৫ হাজার ২৮৬টি। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে মোট বিচ্ছেদের ঘটনা আরও বেশি ছিল। ওই বছর ৭ হাজার ৬৯৮টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগে নথিভুক্ত হয়। এর মধ্যে স্বামীর আবেদন ছিল ২ হাজার ৩১৫টি এবং স্ত্রীর ৫ হাজার ৩৮৩টি।
২০২১ সালে ডিএসসিসিতে বিয়ে বিচ্ছেদ নথিভুক্ত হয় ৭ হাজার ২৪৫টি। এর মধ্যে স্বামীর আবেদন ২ হাজার ৬২টি এবং স্ত্রীর ৫ হাজার ১৮৩টি। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ওই এলাকায় ৬ হাজার ৩৪৫টি বিয়ে বিচ্ছেদের কথা ডিএসসিসির নথিতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরেই বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবিএস সূত্র অনুযায়ী, শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনে ২০১২ সালে বিয়েবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করা হয় ৭ হাজার ৪০২টি, ২০১৩ সালে ৭ হাজার ৭০৮টি ও ২০১৪ সালে ৯ হাজার ৪৫টি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯-এর প্রথম ১৮০ দিনে ৪ হাজার ৫০০ তালাকের আবেদন করা হয়েছিল। প্রতি এক ঘণ্টায় একটি পরিবারকে ভাঙার জন্য একটি আবেদন সিটি করপোরেশনে জমা দেওয়া হচ্ছে। জুন থেকে অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে, বিয়েবিচ্ছেদের হার অনেক বেড়েছে। এ সময় প্রতিদিন ৩৯টি তালাক ছিল। প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক। প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ১৯৪ তালাক হয়। ২০২০ সালে বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বিয়েবিচ্ছেদ ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট-বড় নানা কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এসব কারণের মধ্যে অন্যতম হলো প্রেম এবং মাদকাসক্তি। এছাড়া, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সময় না দেওয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক দাবি, শারীরিক সমস্যা ইত্যাদি কারণে বিচ্ছেদ হচ্ছে।
ডিএসসিসি রাজস্ব বিভাগের গবেষণা কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিয়ে বিচ্ছেদের অধিকাংশের ঘটনার নেপথ্যের কারণ অনৈতিক সম্পর্ক বা পরকীয়া। আগে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটতো স্ত্রীকে নির্যাতন ও যৌতুকের কারণে। আর এখন বেশিরভাগ আবেদনে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন, ভুল বোঝাবুঝি, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি উল্লেখ থাকছে।’ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মেনে নেওয়ার প্রবণতা দিনদিন কমছে বলে মনে করেন তিনি।
সীমাহীন প্রত্যাশা এবং একে-অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ায় বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী দুজনই ভাবেন, আমিই সঠিক, আমিই সুপিরিয়র। ফলে একে অপরকে গুরুত্ব দেন না, সংসারে অশান্তি লেগে থাকে।’
এই সমাজবিজ্ঞানীর মতে, আগে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, সেটি এখন লক্ষ্য করা যায় না। আর বিশ্বাস-শ্রদ্ধা না থাকলে সম্পর্ক বেশিদিন টেকে না, বাস্তবে সেটাই ঘটছে।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তার নিদর্শনের মধ্যে (একটি) হলো এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ (সুরা রুম, আয়াত ২১) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেরূপ ভালোবাসা ও মায়া সৃষ্টি হয়, অনুরূপ ভালোবাসা ও মায়া পৃথিবীর অন্য কোনো দুই ব্যক্তির মধ্যে হয় না। এর মাধ্যমে প্রতিটি দাম্পত্য জীবন হয়ে ওঠে স্বর্গসুখের রাজ্য। যে দৃশ্য তাদের পরস্পরের পরিবারের সদস্যদেরও সুখী করে তোলে।