বজ্রপাতে ১৪ বছরে ৪১৫৮ জনের মৃত্যু

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

২০১০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন ৪ হাজার ১৫৮ জন। নিহতদের মধ্যে শিশু ৭৭৪ জন, নারী ৫৪১ জন এবং পুরুষ ২ হাজার ৮৪২ জন। সবচেয়ে বেশি ৩৬২ জন প্রাণ হারিয়েছেন ২০২১ সালে। এককভাবে সর্বোচ্চ ২৭১ জন পুরুষের মৃত্যু ঘটেছে ২০২০ সালে।

২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব পেতে শুরু করে।

১৪ বছরে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ৪ হাজার ১৫৮ জনের মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ৮৪২ জন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৬৮ শতাংশ। নারী ও শিশুর সংখ্যা যথাক্রমে ৫৪১ ও ৭৭৪ জন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) তথ্যমতে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও এতে প্রাণহানির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষ ঝুঁকিতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। 

বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিবছর মার্চ মাস থেকেই বজ্রপাতের প্রকোপ শুরু হয় এবং বর্ষাকাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। বছরে বজ্রপাতে গড়ে ২৫০ থেকে ৩৫০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা প্রায় ২৮৮ জন। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের প্রথম দশকে দেশজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে মৃতদের বেশিরভাগই হন কৃষক, গৃহবধূ, শ্রমিক এবং স্কুল-কলেজগামী শিশু-কিশোররা।

বজ্রপাতের মৃত্যুর হিসাব নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ডিজাস্টার ফোরাম বলছে, বজ্রপাতে ১৪ বছরে (২০১০-২০২৪) প্রাণ গেল ৪ হাজার ১৫৮ জনের। নিহতদের মধ্যে শিশু ৭৭৪ জন, নারী ৫৪১ জন এবং পুরুষ ২ হাজার ৮৪২ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালে। সেবছর ৩৬২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আর এককভাবে সর্বোচ্চ পুরুষের মৃত্যু ঘটেছে ২০২০ সালে। যার সংখ্যা ২৭১ জন।

২০১০ সালে বজ্রপাতে প্রাণ হারান ১২৩ জন, যা ধীরে ধীরে বেড়ে ২০২১ সালে দাঁড়ায় ৩৬২ জনে। এরপর ২০২২ সালে কিছুটা হ্রাস পেলেও মৃত্যু হয়েছে ৩১৬ জনের। ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৮৮ জন, যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি।

এই সময়কালে বজ্রপাতজনিত আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৪ জনে। ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি আহত হন ১৯৬ জন।

চলতি বছর এপ্রিল ও মে—এই বজ্রপাত মৌসুমে প্রাণহানির ঘটনা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। গত ২৮ এপ্রিল মাত্র একদিনে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩ জন। এদের মধ্যে ১৯ জনই ছিলেন কৃষক—যারা খোলা আকাশের নিচে কাজ করছিলেন। আর শুধু কিশোরগঞ্জ জেলাতেই এপ্রিলের শেষ ভাগ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ১৬ দিনে বজ্রপাতে মারা গেছেন অন্তত ১০ জন।

এরসঙ্গে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিলেট হবিগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রাম এলাকাতেও প্রতিবছরই বজ্রপাতজনিত প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও জলীয় বাষ্প বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে এপ্রিল থেকে জুন মাসে এ প্রবণতা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আগে বজ্রপাত মৌসুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন প্রায় বছরজুড়েই বজ্রপাত হচ্ছে—এটি স্পষ্ট জলবায়ুগত সংকেত।

বজ্রপাত হলো একটি প্রাকৃতিক বৈদ্যুতিক নির্গমন প্রক্রিয়া, যা মূলত আকাশে জমে থাকা বিশাল পরিমাণ ইলেকট্রিক চার্জের হঠাৎ মুক্তি। এটি তখন ঘটে যখন মেঘের ভেতরে কিংবা মেঘ থেকে ভূমির মধ্যে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।

বজ্রমেঘ বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চয়ের প্রধান উৎস। মেঘের ওপরের অংশে পজিটিভ চার্জ এবং নিচের অংশে নেগেটিভ চার্জ জমা হয়। আর ভূমিতে থাকা যেকোনো উচ্চতর বস্তু—যেমন গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বা মানুষের শরীর—এই বৈদ্যুতিক চার্জের সঙ্গে আকর্ষিত হয়ে একটি বৈদ্যুতিক ‘চ্যানেল’ তৈরি করে। ফলস্বরূপ, তীব্র আলোকচ্ছটা ও শব্দসহ সেই চার্জ ‘নির্গত’ হয়। এই ঘটনাই বজ্রপাত।

একটি বজ্রপাত সাধারণত কয়েক মিলিয়ন ভোল্ট বিদ্যুৎ ছড়ায় এবং তাপমাত্রা তাৎক্ষণিকভাবে ৩০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। যা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি গরম। এ কারণে বজ্রপাতে সরাসরি আক্রান্ত ব্যক্তি প্রাণ হারান বা গুরুতরভাবে দগ্ধ হন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা পাঠালেও তা পৌঁছায় না সবার কাছে। কিন্তু গ্রামের কৃষকের হাতে স্মার্টফোন না থাকলে এসব উদ্যোগও ব্যর্থ হয়ে পড়ে। কিছু স্টার্ট-আপ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সতর্কতা পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সেগুলোর নাগাল গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছেনি এখনো।

সেজন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুলে বজ্রপাত বিষয়ক সচেতনতামূলক শিক্ষা থাকা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় সতর্কবার্তা দ্রুত পৌঁছাতে হবে।

এছাড় কৃষকদের জন্য নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে পারলেও মৃত্যু হার কমার সম্ভাবনা রয়েছে। 

বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর প্লাগ খুলে রাখার, জলাশয় থেকে দ্রুত উঠে আসার এবং বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তু থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি শিলাবৃষ্টির সময় ঘরে অবস্থান করার কথাও উল্লেখ করেন আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *