■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
ক্ষমতার মোহকে উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছিলেন ঝুপড়িঘর, বিলাসিতা নয় বরং মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বার বার—সেই হোসে মুজিকা (Jose Mujica) নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছেন। ৮৯ বছর বয়সে নিভে গেল এক দীপ্ত আলো, যে আলো গোটা বিশ্বকে শিখিয়েছিল, নেতৃত্ব মানে সেবা আর জীবন মানে সরলতা। উরুগুয়ের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট রেখে গেলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত—নেতৃত্ব কেবল পদবী নয়, তা হতে পারে আদর্শের নামও।
বুধবার (১৪ মে) এক প্রতিবেদনে এ খবর জানায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ে শাসন করা সাবেক এই গেরিলা তার পরিমিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ‘গরিব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি এক্সে (সাবেক টুইটার) তার পূর্বসূরির মৃত্যুর তথ্য জানিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন ও জনগণের যা করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’
এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুর কারণ জানা না গেলেও তিনি খাদ্যনালীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছিলেন, তিনি ভোগবাদের সমালোচনা করতেন এবং সামাজিক সংস্কার নিয়ে কাজ করেছিলেন। এতে মুজিকা লাতিন আমেরিকা ও এর বাইরেও সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।
মাত্র ৩৪ লাখ বাসিন্দার দেশ উরুগুয়ের প্রেসিডেন্টে হিসেবে তার বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা ছিল কল্পনাতীত। একবার তিনি বলেছিলেন, রাজনীতির পাশাপাশি বই ও জমিতে কাজ করতে ভালো লাগত তার। কাজের প্রতি এই আবেগ তিনি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। মুজিকা দেশটির রাজধানী মন্টেভিডিওতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় হন।
তরুণ বয়সে মুজিকা উরুগুয়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক শক্তি ন্যাশনাল পার্টির সদস্য ছিলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬০-এর দশকে তিনি টুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (এমএলএন-টি) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এটি একটি বামপন্থী শহুরে গেরিলা গ্রুপ ছিল। যারা হামলা, অপহরণ ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত। যদিও তিনি সবসময় বলতেন, কখনো কোনো হত্যা করেননি।
কিউবার বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে, এমএলএন-টি উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে গোপনে প্রতিরোধ প্রচারণা শুরু করে। যদিও তৎকালীন সরকার সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ছিল, তবুও বামপন্থীরা ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী বলে অভিযোগ করতেন।
এ সময় মুজিকাকে চারবার আটক করা হয়। এর মধ্যে একবার, ১৯৭০ সালে তাকে ছয়বার গুলি করা হয় এবং সেবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বেঁচে ফেরেন।
তিনি দুবার কারাগার থেকে পালান, একবার ১০৫ এমএলএন-টি বন্দীদের সঙ্গে একটি টানেলের মধ্য দিয়ে পালান। এ ঘটনাটি ছিল উরুগুয়ের কারাগারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পালানোর ঘটনা।
১৯৭৩ সালে উরুগুয়ের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটালে তাকে ‘নয়জন জিম্মির’ একটি দলে রাখা হয়। ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে তিনি ১৪ বছরের বেশি কারাগারে ছিলেন মুজিকা। এসময় তিনি নির্যাতনের শিকার হন। সেই সময়ের বেশিরভাগ সময় তিনি একা ছিলেন। ১৯৮৫ উরুগুয়ে আবার গণতন্ত্রে ফিরলে তিনি মুক্তি পান।
২০২৪ সালে মুজিকার গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে। মৃত্যুর ঘোষণা দিয়ে ওর্সি লেখেন, গভীর দুঃখের সঙ্গে আমাদের সহকর্মী পেপে মুজিকার মৃত্যু ঘোষণা করছি। আপনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, এবং আপনার মানুষদের প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তার জন্য ধন্যবাদ।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মুজিকা। তিনি দেশকে পরিবেশবান্ধব সংস্কার, সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেওয়া এবং গাঁজা ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার পথে নিয়ে যান।
বিশ্বজুড়ে তিনি পরিচিত ছিলেন তার সরল জীবনধারার জন্য। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ও তিনি বিলাসবহুল প্রাসাদ ছেড়ে রাজধানী মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে নিজ ফুলচাষের খামারে থাকতেন। ২০২২ সালে আল জাজিরাকে তিনি বলেছিলেন, রাজনীতি যদি বিলাসে ডুবে যায়, তা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতিবিদদের দেশের সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করা উচিত, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের মতো নয়।
মুজিকা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাস করতেন একটি সাধারণ খামারে, চালাতেন পুরনো একটি নীল রঙের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ি। এ কারণে অনেকেই তাকে ডাকতেন বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট বলে।
২০২২ সালে আল জাজিরাকে তিনি বলেছিলেন, আমরা একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করি, আর যেন রাজা নির্বাচন করি — লাল গালিচা, প্রাসাদ, রাজকীয় আচরণ। কিন্তু দোষ শূকরছানার নয়, যারা তার পিঠ চুলকায়, তাদের।
প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পরও তিনি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং উরুগুয়ের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন।
২০২৪ সালে তিনি রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সমস্যা হলো, দুনিয়া চালায় বৃদ্ধরা, যারা ভুলে যায় তারা কখনো তরুণ ছিল।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের চিকিৎসায় ক্যানসার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জানা যায় এটি তার যকৃতে ছড়িয়ে পড়েছে।
শেষ জীবনে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি মরতে চলেছি। তবে একজন যোদ্ধার বিশ্রাম নেওয়ার অধিকার তো থাকেই’।
মুজিকার মৃত্যুর পর লাতিন আমেরিকার বামপন্থি নেতারা তাকে স্মরণ করে শোক প্রকাশ করেছেন।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম লেখেন, আমাদের প্রিয় পেপে মুজিকার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সরলতার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের জন্য এক উদাহরণ হয়ে ছিলেন।
চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিচ লেখেন, আপনি আমাদের এমন একটি আশা দিয়ে গেছেন, যে সবকিছু আরও ভালোভাবে করা সম্ভব।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো লেখেন, বিদায় বন্ধু। আশা করি একদিন লাতিন আমেরিকার একটি নিজস্ব সংগীত থাকবে, যা আমাদের ঐক্যের প্রতীক হবে।