■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, শেখ হাসিনার আমলে ২০১০-১১ সালে শেয়ারবাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শেয়ারবাজারে অনিয়ম হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় কোনো বিচার হয়নি। গতকাল ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। ডিএসই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার : দর্শন ও অনুশীলন’ শীর্ষক এই সংলাপে তিনি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অর্থনীতি যে পরিমাণ সৃষ্টিশীল সে তুলনায় অনেক সময় পেরে উঠতে পারছে না বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাজার খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি চালাক, অন্তত নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আরও বেশি চালাক ব্যক্তিদের দায়িত্ব না দিলে বাজারের অনিয়ম ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
দেশের পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা বুঝতে ইতিহাসের দিকে তাকানোর পরামর্শ দিয়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ বাজারে যত কেলেঙ্কারি হয়েছে, তা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের মাধ্যমে। ২০১০-১১ সময়ে এ বাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বিদেশে। অথচ এর কোনো উপযুক্ত বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণ হচ্ছে, তখন যেভাবে মামলা করার দরকার ছিল সেভাবে তা হয়নি। তখন মামলার প্রক্রিয়াই করা হয়েছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না দেওয়াটাকেই সমস্যার মূল বলে মনে করেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, শাস্তি না হলে দুর্নীতি রোধ করা যায় না। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় শেয়ারবাজারে অনিয়ম হয়েছে। তখন হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়ে দেওয়া হয়। তখনো কোনো বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণে ২০১০-১১ সময়ের পরও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যাঁরা অনিয়ম করেছেন তাঁদের কেউ কেউ এখন জেলে। যদিও তা অন্য কারণে। পুঁজিবাজারে অনিয়মের কারণে কেউ শাস্তি পাননি। এটা ছিল পাপের সূত্রপাত। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সঞ্চয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, বিনিয়োগ ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুঁজিবাজার- এটাই বিশ্বে চলে আসছে; কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সে ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, পুঁজিবাজারে যাঁদের যে ভূমিকা তা তাঁরা পালন করেননি। দেবপ্রিয়র প্রশ্ন, ‘তাঁরা কি সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছেন? আমার দৃষ্টিতে পারছেন না।’
শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে চাঁদা (আইপিও) সংগ্রহ বন্ধ। সূচকে হয়েছে বড় ধরনের পতন। ফলে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দুর্বল হয়েছে পুঁজিবাজার এবং ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, পুঁজিবাজার দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান। দিন এনে দিন খাওয়া—এটা এ প্রতিষ্ঠানের চরিত্র না। সামনে বাজেট। টোটকা ওষুধ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এখন সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বড় উদ্যোগ নেওয়া এবং সর্বজনস্বীকৃত একটি প্যাকেজ দরকার।
একই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অর্থনীতি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে দেশের শেয়ারবাজার। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি কোনোটির সঙ্গেই এই শেয়ারবাজারের কোনো সংযোগ নেই। কারণ, এ বিষয়ে কেউ হাত দিতে চায়নি। শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো রাজনৈতিক অংশীদারত্ব নিতে চায়নি কেউ। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও কেউ করেনি। এ পর্যন্ত শেয়ারবাজারের যা কিছু ভালো সংস্কার হয়েছে, বিএনপি আমলেই হয়েছে। ভবিষ্যতে বিএনপি এ বাজারের জন্য আরও বেশি কিছু করবে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এত বছর যারা পুঁজিবাজার চালিয়েছেন, তারা ক্যাসিনোর মতো চালিয়েছেন। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে। দিন শেষে ক্যাসিনো মালিকের লাভ যেমন ঠিকই থাকে, এক শ্রেণির শেয়ারবাজার পরিচালনাকারীরও তাই থেকেছে। অথচ প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা লোকসানের শিকার হয়েছেন। তাই এ বাজারের গুণগত পরিবর্তন দরকার।
বিএনপি আমলে আর্থিক খাত কোনো ধরনের বিপদে পড়েনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মতো সংস্থাকে রাজনৈতিকীকরণ করেনি বিএনপি। ভবিষ্যতেও করা হবে না।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, লুটপাট করতে করতে শেয়ারবাজারকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিতে হয়েছিল। অথচ নিয়ম হচ্ছে শেয়ারের মূল্য ঠিক করবে বাজার। বিনিয়োগকারীরা লোকসান মেনে নিয়েও বাজার থেকে বের হতে পারছিলেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কথা হচ্ছে বিনিয়োগ। এর বিকল্প নেই। বিনিয়োগের অন্যতম উৎস হবে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। অনেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আসতে চান এবং এ জন্য তারা একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন বলেও মন্তব্য করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা আরো বলেন, অনেকেই এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে আসতে চায়। তারা একটি ফ্রি ফেয়ার ইলেকশনের অপেক্ষায় আছে। নির্বাচন হওয়ার পর তারা আসতে চায়, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সরকারকে কেন ৪ বিলিয়ন ডলারের জন্য আইএমএফ’র পেছনে ঘুরতে হবে? ৪ বিলিয়ন ডলার কোনো অর্থ না। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার আসবে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোতে পুঁজিবাজার গুরুত্ব পায়নি বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের যে পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে কিন্তু পুঁজিবাজার নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাজেট পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ পরিকল্পনায় কখনোই পুঁজিবাজারকে রাখা হয়নি। মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময়েও পুঁজিবাজারকে রেখে করা হয় না এখনও।
“আগামী ২০৩৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর অর্থায়ন ব্যাংক খাত করতে পারবে না। এজন্য পুঁজিবাজার হতে পারে বিকল্প।”
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান মুশতাক হুসাইন খান বলেন, ‘‘অর্থনীতিসহ সব খাতে সংস্কার চাইছে সবাই। সংস্কার সবাই চায়, কিন্তু কে সংস্কার করবে? সংস্কারের প্রক্রিয়াটা কেউ জানে না।’’
সংস্কার যাদের স্বার্থ রক্ষা করবে, যারা সংস্কারে উপকৃত হবে এমন গোষ্ঠীর সংখ্যা খুবই কম মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানির ব্যবসার মডেলটি স্বচ্ছ না। তারা সংস্কারে ভয় পায়। তারা মনে করে, সংস্কার করলে মুনাফা করা যাবে না। সংস্কার তারাই চায়, যাদের আন্তর্জাতিক ব্যবসা আছে, আন্তর্জাতিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব রয়েছে। এখানে তো জোর দিতে হবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনাতেও গুরুত্ব দিতে হবে পুঁজিবাজারকে।’’
পুঁজিবাজার সংস্কার কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত ৭৫টি সুপারিশ আসার তথ্য দেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মোহসিন চৌধুরী।
ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘২০১৫ সালে ভিয়েতনামের পুঁজিবাজার আমাদের কাছাকাছি ছিল। এখন তারা শতগুণ এগিয়েছে। এমনকি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের মত দেশের পুঁজিবাজারের সূচক বেড়েছে আমাদের চেয়ে। সম্ভাবনা থাকার পরও কেন বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না।’’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য মোবারক হোসাইন বলেন, “বছরে যে প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে, তার ২৫ শতাংশই ড্রেনেজ (বের করে নেওয়া) হয়। এটা বন্ধ করতে পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে।’’
এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়ক তাসনুভা জাবিন বলেন, ‘‘নতুন দল হিসেবে আমরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এ বিষয়ে পৃথক হব; অন্তত কিছুটা হলেও আলাদা হব- নতুন প্রজন্ম তাই চায়।’’
আলোচনায় বক্তব্য দেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আর প্যানেল আলোচক হিসেবে বিএসইসি কমিশনার মো. মোহসিন চৌধুরী, জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মো. মোবারক হোসাইন, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ, জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক ড. তাজনুভা জাবিন, আইসিএমএবি’র সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।