■ আল জাজিরা ■
পর্যবেক্ষকরা বলছেন বাংলাদেশে নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংকটের মুখে ফেলেছে।
আপাতদৃষ্টিতে এটি ছিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতা ও নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং দেশের তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি নিয়মিত রুদ্ধদ্বার বৈঠক। কিন্তু ২০ মে-র এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল যখন সরকারের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত একাধিক কর্মকর্তা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন যে ঢাকায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে।
বাংলাদেশের সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের মধ্যে “ঠান্ডা যুদ্ধ” হিসেবে চিত্রিত এই উত্তেজনা এখন ইউনূসের ভূমিকার ভবিষ্যৎকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর ইউনূস এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যান। সে সময় তার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন এমন গুজবের মধ্যেই এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
তবে শনিবার (২৪ মে) মন্ত্রিসভার আরেক বৈঠকের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন: “প্রধান উপদেষ্টা [ইউনূস] আমাদের সঙ্গেই আছেন – তিনি পদত্যাগের কোনো কথা বলেননি – এবং অন্য উপদেষ্টারাও আছেন; চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন এই অচলাবস্থা এখনও কাটেনি। এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতা এবং দেশটির নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের নতুন প্রচেষ্টার ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করব।!
আল জাজিরার সাথে কথা বলতে গিয়ে বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তার দল কখনোই চায়নি ইউনূস পদত্যাগ করুক। কেউ তার পদত্যাগ চায়নি এবং আমরাও চাই না তিনি তা করুন। জনগণ তাদের ভোট দেওয়ার এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রায় দুই দশক ধরে তারা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমরা আশা করি তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এভাবেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। নির্বাচনের সময়সূচী নির্ধারণে বিলম্ব নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। এত অপেক্ষার কী আছে? এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে দেশে খুব জোরালো আলোচনা চলছে। বিএনপি চায় কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে বিশেষ করে যাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের অপসারণের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হোক। তারা ইতিমধ্যেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে” ছাত্র প্রতিনিধিদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন। অন্যরা দলীয় বক্তব্য দিয়েছে। যদি আপনি একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক হন তবে এদের সরে যাওয়া উচিত। তিনি সংস্কার এবং নির্বাচনের মধ্যে যেকোনো সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, উভয়ই একই সাথে এগিয়ে যেতে পারে। “যেখানে ঐকমত্য রয়েছে সেখানে সংস্কার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করা যেতে পারে।”
কেন সেনাবাহিনী এবং সরকারের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর গণবিক্ষোভের জের ধরে ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। দেশব্যাপী পুলিশ ধর্মঘটের কারণে বহু থানা পরিত্যক্ত হয় এবং জনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এই ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অব্যাহত উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
যদিও আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশ পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে তবুও দেশের বিরাজমান অস্থিরতার কারণে বেসামরিক-সামরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে।
বুধবার বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রকাশ্যে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দেন যে বেসামরিক দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনীর দীর্ঘায়িত মোতায়েন দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
দ্য ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, জেনারেল ওয়াকার ঢাকা সেনানিবাসে এক উচ্চ পর্যায়ের সমাবেশে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এটি কেবল নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই সম্ভব অনির্বাচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের দ্বারা নয়।” প্রায় ৩০ মিনিটের এক বিরল ভাষণে তিনি এই মন্তব্য করেন এবং এরপর এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রশ্নোত্তর পর্বেও অংশ নেন।
জানা গেছে সারাদেশ থেকে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তারা পূর্ণ সামরিক পোশাকে সশরীরে ও ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন – যা ছিল ঐক্য ও দৃঢ়তার এক প্রদর্শনী।
“সেনাবাহিনী জাতির সুরক্ষার জন্য পুলিশি দায়িত্ব পালনের জন্য নয়… নির্বাচনের পর আমাদের অবশ্যই ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে” দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদনে ওয়াকারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়।
তার এই মন্তব্য ইউনূস প্রশাসনের ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে নির্বাচন না করার ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ইউনূস প্রশাসন মূলত রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় নিশ্চিত করতে চায়, যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যায়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিবেচনাধীন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রস্তাবিত মানবিক করিডোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন “কোনও করিডোর হবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না।” তিনি সতর্ক করে বলেন এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশকে একটি বিপজ্জনক প্রক্সি সংঘাতে ঠেলে দিতে পারে।
পত্রিকাটি অনুসারে, তিনি আরও বলেন “কেবলমাত্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
সেনাপ্রধান নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের সম্ভাব্য বিদেশি ব্যবস্থাপনা এবং ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা স্টারলিংক চালু করার মতো বিষয়গুলো – যা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ” সেনাবাহিনী কাউকে আমাদের সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করতে দেবে না” ডেইলি স্টার তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে।
ইউনূস প্রশাসন গত সপ্তাহে জেনারেল ওয়াকারকে তার পদ থেকে অপসারণের চেষ্টা করেছিল বলে যে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে তার মধ্যেই তার এই মন্তব্য এসেছে।
সেনাবাহিনী বা সরকার কোনো পক্ষই এখনও এ বিষয়ে মুখ খোলেনি বা বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। যদিও নিশ্চিত নয়, এই গুজব জনসাধারণের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে এবং ক্রান্তিকালীন সময়ে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে জেনারেল ওয়াকারের এমন জোরালো প্রকাশ্য বিবৃতির সময় এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর তার গুরুত্বারোপ—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেসামরিক পরিমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান উদ্যোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বাড়তে থাকা অস্বস্তিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও কি উত্তেজনা আছে?
হ্যাঁ। গত বছরের ৮ আগস্ট গঠিত হওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিলেও এই বছরের শুরুতে গঠিত ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি) এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল যুক্তি দেখাচ্ছে যে গত বছর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের ফলে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার ও ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম যেকোনো নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন করতে হবে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্যান্য দাবিতেও বিক্ষোভ করছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ শাসনামলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ও কারচুপির নির্বাচনে পরাজিত হওয়া তাদের মেয়র প্রার্থীকে স্বপদে পুনর্বহাল করা।
বৃহস্পতিবার বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলন করে বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচনের দাবি জানায় এবং একইসঙ্গে দুজন ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগেরও দাবি তোলে। এসব পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলেও দলটি সতর্ক করে।
শনিবার ইউনূস দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (বিজেআই) সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউনূস কি পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন?
শনিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ঘোষণা করা হয় যে ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করবেন না। কিন্তু এই ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার মধ্যে জল্পনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে যে তিনি পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি পদত্যাগ করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় গত জুলাইয়ে পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা ও নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) বর্তমান প্রধান নাহিদ ইসলাম অপর দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাকে পদে বহাল থাকার অনুরোধ জানান।
বৈঠকের পর নাহিদ বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেন যে ইউনূস পদত্যাগের কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন।শুক্রবার সন্ধ্যা (১৩:০০ জিএমটি) নাগাদ অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের সূত্র আল জাজিরাকে জানিয়েছে যে ইউনূস তখনও তার বিকল্পগুলো বিবেচনা করছেন।
কেন ইউনূস পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন?
স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী তীব্র রাজনৈতিক চাপের কারণেই ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
দৈনিক সমকাল দুজন উপদেষ্টার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইউনূস বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বলেছেন যে রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছর হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নির্বাচন আয়োজনের জন্যেও চাপ বাড়ছে। “বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ” বলেন তিনি। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে যেকোনো নির্বাচনে হস্তক্ষেপ বা কারচুপি হতে পারে এবং তিনি এর দায় নিতে চাননি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইউনূস তার সরকারি বাসভবন যমুনা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। পরে বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার সময় নাহিদ নিশ্চিত করেন যে ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন এবং ইউনূসকে উদ্ধৃত করে বলেন যে তিনি বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে “জিম্মি” বোধ করছেন।
“আপনারা সমস্ত রাজনৈতিক দল যদি একটি সাধারণ সমাধানে পৌঁছাতে না পারেন তাহলে আমি এভাবে কাজ করতে পারব না” নাহিদ ইউনূসকে উদ্ধৃত করে বলেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন নেতাকে “শক্তিশালী থাকার” আহ্বান জানান এবং জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনগণ তার ওপর যে আস্থা রেখেছিল সে বিষয়টির ওপর জোর দেন।
এদিকে ইউনূসের উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচি থমকে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ—পুলিশ এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র সহ—ক্রমশই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
তাদের মতে এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুটি পৃথক সত্তায় বিভক্ত করার প্রস্তাব। এনবিআর দেশের আয়কর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং শুল্ক আদায়ের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ।
সরকারের ভাষ্যমতে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াবে। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাদের আশঙ্কা এর ফলে অভিজ্ঞ রাজস্ব কর্মকর্তাদের গুরুত্বহীন পদে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।
বিএনপি কী চায়
আল জাজিরার সাথে কথা বলতে গিয়ে বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তার দল কখনোই চায়নি ইউনূস পদত্যাগ করুক। “কেউ তার পদত্যাগ চায়নি এবং আমরাও চাই না তিনি তা করুন” বলেন তিনি।
খসরু আরো বলেন, “জনগণ তাদের ভোট দেওয়ার এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রায় দুই দশক ধরে তারা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমরা আশা করি তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এভাবেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন।”
নির্বাচনের সময়সূচী নির্ধারণে বিলম্ব নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। “এত অপেক্ষার কী আছে? এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে দেশে খুব জোরালো আলোচনা চলছে।”
খসরু বলেন, বিএনপি চায় কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে বিশেষ করে যাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের অপসারণের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হোক। “তারা ইতিমধ্যেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে” ছাত্র প্রতিনিধিদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন। “অন্যরা দলীয় বক্তব্য দিয়েছে। যদি আপনি একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক হন তবে এদের সরে যাওয়া উচিত।”
তিনি সংস্কার এবং নির্বাচনের মধ্যে যেকোনো সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, উভয়ই একই সাথে এগিয়ে যেতে পারে। “যেখানে ঐকমত্য রয়েছে সেখানে সংস্কার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করা যেতে পারে।”
খসরু নির্বাচন কমিশন এবং সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। “এটি শেখ হাসিনার যুগ নয়” – নির্বাচনের জন্য আরও অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের ইঙ্গিত দিয়ে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রাক্তন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের প্রশ্নে তিনি বলেন বিচারিক প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে চলতে পারে। “বিচার বিভাগকে তার কাজ করতে হবে – প্রয়োজনে নির্বাচিত সরকার সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে।”
“পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বিএনপি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে” তিনি আরও বলেন। “এই বিচার একটি জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়।”
এদিকে শুক্রবার এক টিভি সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করেছেন এই বলে: “যদি ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে তার দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন তাহলে রাষ্ট্র বিকল্প খুঁজে বের করবে।” তবে তিনি এও বলেন: “বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমরা আশা করি তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে একটি নির্বাচনী রূপরেখা ঘোষণা করবেন।”
অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়?
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বিএনপির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে আল জাজিরাকে বলেন: “জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সকল দলেরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন করার কথা ছিল কিন্তু বিএনপি পেশিশক্তির ওপর ভিত্তি করে পুরনো কৌশল অবলম্বন করেছে – এটাই সংকটের মূল।”
তিনি ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন: “জাতীয় স্বার্থে বিএনপি এবং অন্যান্য সকল দলকে একত্রিত হতে হবে।”
এদিকে ঢাকা জুড়ে বিক্ষোভ এবং নেপথ্যে বৈঠক অব্যাহত ছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এনসিপি সহ পাঁচটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা আরেকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (আইএবি) প্রধান মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের আহ্বানে একটি জরুরি বৈঠকে যোগ দেন।
তারা সকল “ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে” ঐক্যবদ্ধ হতে জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পরে ইউনূসের অধীনে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের যুক্তি অতীতের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধে আনুপাতিক ভোটদান ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং অতীতের অপকর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শেষে নির্বাচন হওয়া উচিত। তারা মনে করে এই পরিবর্তনগুলো ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা জনগণের আস্থা আরও কমাবে এবং নতুন সংকট তৈরি করবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান ফোনের মাধ্যমে আইএবি সভায় যোগ দেন এবং প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। বৃহস্পতিবার তিনি ইউনূসকে সংকট সমাধানের জন্য সর্বদলীয় সংলাপ আহ্বানের অনুরোধ জানান।
এরপর শুক্রবার রাতে জামায়াতে ইসলামীর ডাঃ শফিকুর রহমান ইউনূসের সাথে একটি বৈঠকের অনুরোধ করেন এবং শনিবার ১২:০০ জিএমটি (স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা) তে বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন।
শুক্রবার রাতে আল জাজিরার সাথে আলাপকালে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারওয়ার তুষার বলেন: “গুজব যাই হোক না কেন আমরা বিশ্বাস করি ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জনগণ উভয়ের কাছ থেকেই ব্যাপক প্রত্যাশা রয়েছে” তিনি আরও বলেন।
রাজনৈতিক বিভাজনের কথা স্বীকার করে তুষার বলেন: “যদি সবাই দলীয় এজেন্ডার ঊর্ধ্বে গিয়ে জাতীয় এজেন্ডার ওপর মনোনিবেশ করে তাহলে সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সমাধান সম্ভব।”
আমরা এরপর কী আশা করতে পারি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি আল জাজিরাকে বলেন, ইউনূসের পদত্যাগের আলোচনা হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ঐক্যের অভাব নিয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশারই প্রতিফলন। “গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তা দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে” তিনি বলেন। “পদত্যাগের আলোচনা হয়তো সেই ঐক্য পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়ার একটি সংকেত হতে পারে।”
রনি আরও বলেন কিছু সরকারি নিয়োগ রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে থাকতে পারে যা প্রশ্ন তৈরি করে যে সরকারের সংস্কার কর্মসূচির বাইরেও নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির অন্য কোনো অ্যাজেন্ডা রয়েছে কিনা। “এটি একটি কারণ হতে পারে যে সরকার ব্যাপক রাজনৈতিক সহযোগিতা অর্জন এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে” তিনি উল্লেখ করেন।
রনি বলেন: “এই মুহূর্তে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলার ফলে [প্রশাসন] রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা কাকে তাদের নেতা হিসেবে চায়।”
তবে এনসিপির নাহিদ ইসলাম ভিন্ন মত পোষণ করেন। শুক্রবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি সতর্ক করে বলেন: “গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করার এবং আরও একটি ১/১১-ধাঁচের ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।”
এক-এগারো বলতে ১১ জানুয়ারী ২০০৭ সালকে বোঝায় যখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সামরিক-সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে দুই বছর শাসন করেছিল। “দেশকে দুর্বল রাখার জন্য বাংলাদেশকে বারবার বিভক্ত করা হয়েছে জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করা হয়েছে” নাহিদ লিখেছেন।
ইউনূসকে পদে থাকার এবং সংস্কার ন্যায়বিচার ও ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ডঃ ইউনূসকে পদে থাকাকালীন সকল রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে হবে।”
তিনি এনসিপির দাবিগুলোও তুলে ধরেন: জুলাইয়ের ঘোষণা অনুযায়ী সময়মতো পদক্ষেপ; ঘোষিত সময়সীমার (ইউনূস বারবার ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) মধ্যে নির্বাচন; নির্বাচনের আগে জুলাইয়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মৌলিক সংস্কার; জুলাই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান বিচার এবং গণপরিষদ ও আইনসভার যুগপৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের রূপরেখা।
এদিকে জনসাধারণের উদ্বেগ বাড়ছে। শুক্রবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি ফেসবুক সতর্কবার্তা জারি করে। এতে একদিন আগে সেনাবাহিনীর লোগো ব্যবহার করে সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্যে “বিভ্রান্তি ও ফাটল সৃষ্টির সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা” হিসেবে প্রচারিত একটি ভুয়া মিডিয়া বিজ্ঞপ্তিটিকে অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে সতর্ক করা হয়েছে “গুজবে বিশ্বাস করবেন না। বিভ্রান্ত হবেন না।”
সপ্তাহটি যতই এগিয়ে যাচ্ছে সকলের দৃষ্টি এখন মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে – তিনি কি পারবেন দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে গত বছরের নাটকীয় গণঅভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট এই ক্রান্তিকালে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে একটি নতুন জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে?
বাংলাদেশি সাংবাদিক মওদুদ আহমেদ সুজনের লেখা আল জাজিরা থেকে অনূদিত