নাস্তিক আখ্যা দেওয়ায় ঢাবি শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

‘আমি নাস্তিক নই’ স্ট্যাটাস দিয়ে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় শাকিল আহমেদ (২৪) নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মঙ্গলবার সকালে উপজেলার দক্ষিণ জামশা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

প্রায় আট মাস আগে নিজের ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি থেকে কমেন্ট করা একটি পোস্ট নতুন করে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে হুমকি দেন। পরে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

মৃত শাকিল (২৪) দক্ষিণ জামশা গ্রামের নাসিরুদ্দিনের ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় সাত থেকে আট মাস আগে নিজের ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তিকর কমেন্ট করেন শাকিল আহমেদ। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি কমেন্ট কেটে ফেলেন। এর পর গত সোমবার ওই কমেন্ট ফেসবুকে নতুন করে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে ফেসবুকে শাকিলকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে হুমকি ধমকি দেন।

সোমবার রাতে নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষজন বাড়িতে গিয়ে শাকিলকে ও তার পরিবারকে হুমকি ধমকি দেন। এর পর ওইদিন গত রাত ২টার দিকে ঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

এ ব্যাপারে সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জেওএম তৌফিক আজম বলেন, সকালে বাড়ি থেকে ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

আত্মহত্যার আগে সোমবার রাতে ফেসবুকে চারটি পোস্ট দিয়েছিলেন শাকিল। সর্বশেষ পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমি নাস্তিক নই, গ্রামের সবাই আমাকে নাস্তিক বলছে। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে, আমি নবী মুহাম্মদকে কোনো কটূক্তি করিনি। আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক গর্ব করত, গ্রামের সবাই আমাকে অনেক সম্মান করত। আজ আমি আমার নিজের আপন মানুষের কাছে আমার সম্মান হারিয়েছি। আগামীকাল আমার বাবাকে সবাই গালি দিবে, আমার মাকে সবাই অসম্মান করবে, এই লজ্জা আমি কখনো সহ্য করতে পারব না। একটা ছেলে হয়ে নিজের বাবা–মায়ের মানসম্মান আমি এভাবে নষ্ট করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারব না। কোনো দিন আমি গ্রামে মাথা তুলে চলতে পারব না। আত্মহত্যা মহাপাপ আমি জানি। আমি অনেক পাপ করেছি, আজ আর একটা শেষ পাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।’

শাকিলের ফেসবুক আইডির নাম ‘শাকিল চিত্রকর’। সোমবার রাতে সেই আইডি থেকে পরপর কয়েকটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে জামসা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, “আমার ওয়ার্ডের নুসনের ছেলে আত্মহত্যা করেছে বলে শুনেছি। তবে কেন আত্মহত্যা করেছে আমি জানি না। আর কী ঘটনা ঘটেছে জানি না, আমি জমিতে কাজে ব্যস্ত।”

তবে ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, “ফেসবুকে মহানবীকে (স.) নিয়ে কয়েক মাস আগের একটি পোস্ট সম্প্রতি সামনে এলে এলাকার গণ্যমান্যরা তার বাড়িতে গিয়ে বিষয়টা বললে সমাধান হয়ে যায় বলে শুনেছি। পরে লজ্জায় সে আত্মহত্যা করেছে।”

এ বিষয়ে শাকিলের খালাতো বোন মুক্তা বলেন, “গতকাল (সোমবার) রাতে ফেসবুকের পোস্টের মন্তব্য নিয়ে জামশাসহ আশপাশের কয়েকশ লোক এসে শাকিলের বাড়িতে হুমকি দেয়। পরে রাতে তিনি আত্মহত্যা করেন।”

শাকিলের সহপাঠী তুশি আক্তার বলেন, শাকিল চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। গতকাল রাতে তিনি পোস্ট দেওয়ার পরে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করতে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ হওয়ায় যোগাযোগ করতে পারেনি। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে জানতে পারলাম তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, “বিষয়টা আমি শুনেছি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে বছর দুয়েক আগে পাস করে বের হয়ে গেছে। তারপরও বিষয়টা নিয়ে আমি আমার সহকর্মীদের খোঁজখবর নিতে বলেছি।”

ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক এবং সাধারণ সম্পাদক আকাশ আলীর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘৯ জুন দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে ক্রমাগত হুমকির মুখে আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়ে যান, তার সঙ্গে কতিপয় ব্যক্তির ভুল বোঝাবুঝির জের ধরে তার উপর অনলাইন মব চালানো হয় এবং তার পরিবারের ওপর হুমকি দেওয়া হয়। ১ বছরের পুরোনো একটি ফেসবুক কমেন্টকে কেন্দ্র করে তার নামে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি ফেসবুকে বেশ কয়েকবার ক্ষমা চেয়েও মবের হাত থেকে রক্ষা পাননি। শাকিল মব ভায়োলেন্স এড়ানোর জন্যই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।’

মব সৃষ্টিকারীদের বিচারের দাবি জানিয়ে বলা হয়, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিষয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তাই শাকিলের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী। শাকিলের আত্মহত্যায় জড়িত মব সৃষ্টিকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *