■ মাশরিন জাহান মনি ■
এই গল্পটা আমার। একান্ত আমার নিজের।
এই গল্পের সূচনাকাল চাইলে পঁচিশ বছর আগে ধরা যায়, আবার সাত বছর আগেও ধরা যায়।
কিন্তু আমি পঁচিশ বছর আগে যাবোনা। কেননা, সাত বছর আগে যে ধাক্কাটা খেয়েছি, সে ধাক্কাটা না খেলে আমি পঁচিশ বছর আগের ঘটনায় যেতে পারতাম না। কোনোদিন না।
যে মানুষটাকে আমি আব্বা ডাকতাম, তার নাম আলী হায়দার। উপজেলা ভূমি অফিসের একজন নিম্নশ্রেণীর কর্মকর্তা। খুব সাধারণ, সাধাসিধে একজন মানুষ। চাইলে জীবনে অনেককিছুই করতে পারতেন৷ কিন্তু সারাজীবন সৎ থাকতে গিয়ে দেখা গেলো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেই হিমশিম খাচ্ছেন। পঞ্চাশোর্ধ এই মানুষটি ২৯ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন শাহানাজ বেগমকে। আমি কিছু বুঝতে শেখার আগেই শাহানাজ বেগম আমাকে শিখিয়েছিলেন তাকে মা ডাকতে। বুঝতে শেখার পর এটা নিয়ে আমার অভিযোগের সীমা ছিলোনা। আমার আশেপাশের সবাই মা কে আম্মু, বাবাকে আব্বু ডাকতো। কেউ কেউ তো এক কাঠি ওপরে গিয়ে বাবাকে ডাকতো বাপি। কিন্তু শাহানাজ বেগম আমাকে শিখিয়েছিলেন মাকে ডাকতে হবে মা, বাবাকে আব্বা। বন্ধুবান্ধব, খেলার সাথীদের সামনে মাকে ‘আম্মু’ না ডেকে মা ডাকতে লজ্জায় মরে যেতাম ওই ছোট্ট বয়সে।
আমরা থাকতাম উপজেলা সরকারি কোয়ার্টারে। পুরাতন আমলের বিল্ডিং। জায়গায় জায়গায় দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। তিন রুমের কোয়ার্টার। একটায় আব্বা আর মা ঘুমাতো। আরেকটায় আমি। বাকি রুমটায় গাদাগাদি করে রাখা ছিলো রাজ্যের সব জিনিস। মা বলতো ট্যাপা বড় হলে এই রুম সুন্দর করে গুছিয়ে ওকে দেয়া হবে। ট্যাপা আমার ছোটোভাই। আমাদের বয়সের ফারাক দশ বছর। কাজেই ওর বড় হতে অনেক দেরি। আব্বা বলতো ট্যাপা বড় হতে হতে আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি হবে। আব্বা টাকা জমাচ্ছিলেন। ছোটোখাটো একটা জমি দেখে রেখেছেন। উপজেলা শহর থেকে বেশ দূরে। সেটা নাকি জলের দামে বিক্রি হবে।
আমি ভেবেছিলাম আমার হয়তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর। কিন্তু দুনিয়ার সমস্ত জায়গা নিয়ে দুইজন মানুষ অপেক্ষা করে ছিলেন আমার ফেরার। সেখানে আমার নাড়ির টান নেই। কিন্তু আব্বার হাত ধরে শাহানাজ বেগম নামে এক নারীর টানে আমি ফিরছি আবার সেখানে। সাত বছর পর। সেই নারী আমাকে শিখিয়েছিলো তাকে এমন একটি শব্দে ডাকতে, যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ- ‘মা’
পরে জেনেছি সেটা একটা বদ্ধ জলাশয়। আব্বার আশা ছিলো কমদামে সেটা কিনে ভরাট করে সেখানে বাড়ি করবেন। সেই আশায় টাকা জমাচ্ছিলেন একটু একটু করে। আমরা চারজন মিলে স্বপ্ন দেখতাম আমাদের নতুন বাড়ির। ট্যাপা আবদার করে- বাড়িতে অনেক গোপন জায়গা থাকতে হবে যাতে লুকোচুরি খেলা যায়। আমরা সবাই ওর কথা শুনে হো হো করে হাসি। তিন রুমের সেই পলেস্তারা খসা বাড়িটায় ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যতা হয়তো ছিলোনা, কিন্তু বিধাতা সেই বাড়িতে কানায় কানায় সুখ দিয়েছিলেন। সেই সুখ আলপনা হয়ে লেগে থাকতো পলেস্তারা খসা প্রত্যেকটা দেয়ালে।
ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসতাম আব্বা বদলি হবেন, বেতন বাড়বে। কিন্তু আমার জীবনের প্রায় পুরোটা অংশ কেটেছে ওই পলেস্তারা খসা তিন রুমের কোয়ার্টারেই। আব্বার বদলি হলো না কোথাও। বেতন যা বেড়েছে, তা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিয়ে খুব একটা যুত করতে পারেনি। কিন্তু এর মাঝেও আব্বা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন জেলার সবচেয়ে নামকরা কলেজটায়। উপজেলা শহর থেকে জেলা শহর খুব একটা দূরে ছিলোনা। দশটাকা বাসভাড়া দিয়েই যাওয়া যেতো। যাওয়া আসার বিশ টাকা, আর আমার হাতখরচ এর দশটাকা সহ আব্বা আমাকে তিরিশ টাকা দিতেন রোজ। আমি সেই তিরিশ টাকা যত্ন করে জমাতাম প্রায় প্রতিদিন।
প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা আমি হেঁটে হেঁটে কলেজ করতাম। গুণে দেখেছিলাম বেশি জোরে হাঁটলে ৪৩ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আর একটু আস্তেধীরে হাঁটলে একঘন্টার মতো লাগে।
আমার অবশ্য হাঁটতে বেশ লাগতো। যাওয়ার পথে সকাল সকাল বই হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়ে ক্লাসের অসম্পূর্ণ পড়াটা রাস্তাতেই পড়ে নিতে পারতাম।
রোজ কলেজ, আর দুইটা প্রাইভেট শেষ করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল পার হয়ে যেতো। দেখতাম আব্বা অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন ফ্যানের নিচে। আব্বার দিকে তাকালে খুব মায়া হতো। মনে হতো যেভাবেই হোক ইন্টারমিডিয়েটে এ প্লাস পেয়ে আমাকে মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে! খুব তুখোড় ছাত্রী ছিলাম না, কিন্তু একেবারে খারাপও ছিলাম না। আমি জানতাম একটু পরিশ্রম করলেই আমি পারবো। তাই করছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট এর তখন তিনমাস বাকি। কলেজ যেতে হয়না। প্রাইভেটগুলোও বাদ দিয়েছি। সারাদিন রুমে বসে পড়ি। আত্মীয়স্বজন, দাওয়াত সব থেকে মুখ ফিরিয়ে আমি তখন পড়াশোনায় বুঁদ হয়ে গেছি।
সেদিন বাড়িতে একা ছিলাম আমি। আব্বা অফিসে।
মা ট্যাপাকে নিয়ে স্কুলে। পড়তে ভালো লাগছিলো না। বসলাম ছবির এলবাম নিয়ে। আমাদের একটা ঢাউস মার্কা পারিবারিক এলবাম ছিলো। অনেকদিন দেখা হয়নি। হঠাৎ ইচ্ছে হলো দেখি।
কত কত ছবি! আব্বার বিয়ের আগের ছবি। মার ছবি। বেশিরভাগ ছবিই ঝাপসা। লেমিনেটিং করা হয়নি বলে জায়গায় জায়গায় অস্পষ্ট। আব্বা আর মার বিয়ের ছবিগুলোও বেশ ঝাপসা।
তবুও দেখতে ভালোই লাগছিলো। মার অল্পবয়সের ছবি। বিয়ের ছবি বেশি নেই। ঘরোয়া বিয়ে। যে কয়টা ছবি আছে, তার কোনোটায় হয় আব্বা একা, নয় মা। শুধু একটা ছবিতে আব্বা আর মা একসাথে বসে খাচ্ছে। ছবিটা উল্টিয়ে পরের ছবিতে যাবার আগে হঠাৎ আমার চোখ গেলো ছবির নিচের দিকে। ছবির নিচে তারিখ, আর সাল। কিন্তু মনে হচ্ছে এই অংশটুকু যত্ন করে ঘষে মুছে ফেলা হয়েছে। আমি বাকি ছবিগুলোও দেখলাম। শুধু বিয়ের ছবিগুলো বাদে বাকি সব ছবিতে তারিখ, সাল স্পষ্ট। আর বিয়ের সবকটা ছবিতে তারিখ আর সাল একই কায়দায় মুছে দেয়া। কৌতুহল জাগলো মনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম মুছে ফেলা অংশটুকু। একটা ছবিতে সালের অংশটায় একটা সংখ্যা হালকা বোঝা যাচ্ছে। তৃতীয় সংখ্যাটা। শূন্য।
কেমন খটকা লাগলো। আমার জন্ম ১৯৯৮ সালে। সেই হিসাব অনুযায়ী আব্বা আর মার বিয়ে হওয়ার কথা ১৯৯০-১৯৯৭ এর মাঝামাঝি যেকোনো এক সালে। এর কোনোটাতেই তৃতীয় সংখ্যাটা ০ হবার কথা নয়। কাছাকাছি একটা সালেই তৃতীয় সংখ্যাটা ০- ২০০০ সাল।
তারমানে কি আব্বা মার বিয়ে হয়েছে ২০০০ সালে? কিভাবে সম্ভব?
আব্বার রুম থেকে আলমারির চাবি খুঁজে বের করে আমি ঢুকলাম ট্যাপার জন্য বরাদ্দ থাকা রুমটায়। অসংখ্য জিনিসপত্র এই রুমে। আলমারি খুলতে হবে আমার। আলমারির ড্রয়ারে সব দরকারি কাগজপত্র থাকে। কোনোদিন এসব কাগজপত্র ঘাঁটার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু সেদিন পাগলের মতো খুঁজলাম কিছু কাগজ। পেয়েও গেলাম। আব্বা আর মায়ের বিয়ের কাগজপত্র। হ্যাঁ, সালটা স্পষ্ট। দুই এর পরে তিনটা শুন্য। দুই হাজার সাল। বুঝে গেলাম আমি আব্বা মার সন্তান নই।
১৯৯৮ সালে আমার জন্ম হলে তখন আমার বয়স হওয়ার কথা ১৮।
অষ্টাদশী মেয়েদের আবেগ হলো পদ্মপাতার জল। খুব সহজে এরা অভিমানী হয়, খুব সহজে যেমন এরা বিশ্বাস করতে পারে, অবিশ্বাসও করতে পারে। এ বয়সে সন্দেহ জন্মায় মনে, সবকিছুকে প্রশ্ন করতে শেখে তারা। আমি ধাক্কাটা খেলাম ওই বয়সেই।
খুব কাঁদলাম এরপর। খুব। মাথায় একটাই প্রশ্ন।
আমি কার সন্তান?
আব্বার অপর পক্ষের সন্তান? নাকি মায়ের?
আমাদের জীবনটা কোনো গল্প উপন্যাস নয়। হলে হয়তো কাহিনিটা হতো খুব নাটকীয়। দেখা যেত আমার আসল মা মারা গেছেন। আব্বা এরপর আমাকে নিয়ে পড়ে গেছেন মাঝদরিয়ায়। একদিকে অফিস, অন্যদিকে এই দুধের বাচ্চা। সেই সময় তার জীবনে এলো শাহানাজ বেগম। আব্বা তার থেকে কথা নিলেন আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করতে হবে। তারপর আমাকে নিয়ে শুরু হলো তাদের নতুন সংসার।
কিন্তু জীবন গল্প উপন্যাসের থেকেও নাটকীয়। অনেক বেশি।
সেই নাটকীয় সত্যটা আমি শুনলাম। শান্তভাবে।
আব্বা আমাকে শোনালেন আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কাহিনি। আমি শুনলাম। একটা ভাঙা হৃদয় নিয়ে৷ আমি ভেবেছিলাম হয়তো হৃদয়টা ভাঙার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু দেখলাম কাঁচের চেয়েও ভঙুর এই হৃদয়, চুরমার হয়েও অপেক্ষা করে আরো ভেঙে যাবার জন্য।
আব্বা ছিলেন এতিম। কোনোমতে হাইস্কুলটা পাশ করে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। কাজ নিলেন পুরান ঢাকার এক চালের আড়তে। আড়তের মালিক রঘু সাহা। মালিকের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে থাকবার জায়গা হয়েছিলো আব্বার। ভর্তি হয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে। চালের আড়তে বসতেন রাত দিন মিলিয়ে বারো ঘন্টা। যা টাকা আসতো, তাই দিয়ে চালাতেন কলেজের খরচ।
আই.এ. পাশ করে জগন্নাথ কলেজ থেকেই বি.এ. পাশ করলেন। চাকরি খুঁজছিলেন ছোটোখাটো। পেয়েও যেতেন হয়তো আরেকটু খুঁজলে। কিন্তু সেসময়ে ঘটে গেলো একটা অঘটন।
রঘু সাহার মেজো মেয়েটা- মহুয়া সাহা পালিয়ে গিয়েছিলো এক ছেলের সাথে। তারপর তিনমাস পর যখন ফিরে এলো, তার সিঁথির সিঁদুর অনেকটা ফ্যাকাশে। জানা গেলো যে ছেলেটির সাথে সে পালিয়েছিলো, গত পনের দিন ধরে সে লাপাত্তা। ঘরে চাল নেই, হাতে টাকা নেই। অগত্যা ফিরতে হলো তাকে বাপের কাছেই। রঘু সাহা বিনাবাক্যব্যায়ে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু কথা বলেননি একটাও। মাসখানেক পর বোঝা গেলো মহুয়া সাহা একা ফেরেনি। তার ভেতরে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব।
সময়টা ১৯৯৮ সাল। আব্বা হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিলেন। সেসময়ে মহুয়া সাহার একটা মেয়ে হলো। রঘু সাহা অতিকষ্টে পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু নতুন এই শিশুবাচ্চাটিকে নিয়ে তিনি পড়ে গেলেন ফ্যাসাদে। রঘু সাহার প্রয়োজন ছিলো একজোড়া বিশ্বাসী হাত, যে হাতে তিনি এই বাচ্চাটা তুলে দিতে পারবেন।
আর আব্বার প্রয়োজন ছিলো একটা ভালো চাকরি। রঘু সাহা আব্বাকে অভয় দিলেন চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। কিছু কাঁচা টাকাও হয়তো হাতে গুঁজে দিতে চেয়েছিলেন।
আমি কেন তখন কাঁদছিলাম আমি জানিনা। কাঁদছিলেন তিনিও। যেন কত জন্মের কান্না জমে ছিলো তার বুকে। সব উজাড় করে কাঁদছিলেন।
এর পরের কাহিনি খুব সংক্ষিপ্ত।
মহুয়া সাহা যদিও এখন মহুয়া ঘোষ হয়ে গেছেন, তবুও আমি তাকে মহুয়া সাহাই বলবো। মহুয়া সাহা চেয়েছিলেন আমি যেন তার সাথে থাকি। কিন্তু এই উজ্জ্বল লাবণ্যময়ী চেহারা, দামী কাপড়চোপড় আর সিঁথিভর্তি সিঁদুরে রাঙা এই মহিলাটিকে মা ভাবতে পারিনি আমি। মা উচ্চারণ করলেই আমার চোখে ভাসে ফিরোজা রঙের সুতি শাড়ি পরা, গায়ে মশলার ঘ্রাণওয়ালা, খুব আটপৌরে শাহানাজ বেগমের চেহারা। আমার শান্তি মেলেনা কোথাও। আমি মহুয়া সাহাকে ছেড়ে চলে আসি তূরের কাছে। রিকশায় উঠে তূর আমার মাথাটা চেপে ধরে তার কাঁধে। আমি নিঃশব্দে কেঁদে যাই। তূর কোনো কথা বলে না। আমার চোখের জলে তূরের শার্ট ভিজে যায়। সেদিনই বুঝে যাই তূর আমার শুধু বন্ধু নয়। এর থেকে বেশি কিছু।
আব্বার দুর্দিনে এই রঘু সাহাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের আড়তে কাজ দিয়েছেন। থাকার জায়গা দিয়েছেন।
তাই আব্বা রঘু সাহাকে সেদিন ফেরাতে পারেননি। আব্বা নিজেও এতিম ছিলেন, হয়তো সেকারণেও সেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তার মায়া লেগেছিলো।
রঘু সাহা আব্বাকে ভূমি অফিসে চাকরি নিয়ে দিলেন। পোস্টিং হলো পঞ্চগড়ে। তারপর একহাতে সেই বাচ্চাটা, আরেক হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে আব্বা ঢাকা ছাড়লেন। এরপর আর কোনোদিন তিনি ঢাকায় যাননি। আব্বার বয়স তখন ২৮। পরের বছর আব্বা পঞ্চগড়েই বিয়ে করলেন। শাহানাজ বেগমকে।
শাহানাজ বেগম সংসারে এসে দেখলেন ভূমি অফিসের কোয়ার্টারের বারান্দায় এক বছরের একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে। এই বাচ্চা শিশুকে তিনি বুকে তুলে নিলেন। খুব যত্নে কথা শেখালেন। শেখালেন আলী হায়দারকে আব্বা ডাকতে, আর তাকে মা।
এরপর সাত বছর পার হয়ে গেছে। এখনো এসব ভাবলে আমার পুরো পৃথিবী দোদুল্যমান হয়ে যায়। আর তখন তো ছিলাম সবে আঠারোর কিশোরী। আমি সহজভাবে নিতে পারিনি। তাসের ঘরের মতো সমস্ত দুনিয়া হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিলো সেই অষ্টাদশী কিশোরীর মাথায়। শাহানাজ বেগম, আর আলী হায়দার আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন অনেক। কিন্তু নির্মম সত্যটা তখন ধারালো চাকুর মতো গেঁথে আছে আমার হৃদপিণ্ড বরাবর। আমি তাদেরকে পর করে দিলাম। আব্বা ডাকা ভুলে গেলাম। মা ডাকা ভুলে গেলাম। নিজেকে বন্দী করে ফেললাম ছোট্ট একটা রুমে। খোলা পড়ে রইলো আমার রসায়নের পাতা, অসমাপ্ত থেকে গেলো পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমস্যা।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় খুব খারাপ করলাম।
পরীক্ষার পর আলী হায়দারকে গিয়ে বললাম, ‘আমি ঢাকা যাবো। ব্যবস্থা করেন।’
আলী হায়দার ঢাকা ছেড়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। আমাকে নিয়ে।
আমি তাকে রেখে তার পরিচয় অস্বীকার করে আঠারো বছর পর ঢাকায় এলাম। ২০১৭ সালে। উঠেছিলাম শাহানাজ বেগম এর দুঃসম্পর্কের ভাই এর বাসায়। কোচিং-এ ভর্তি হলাম। জানি কিছুই হবে না। তবুও, ঢাকায় থাকার একটা ছুতো তো দরকার! কোচিং এ শুধু যেতাম আসতাম। ক্লাসে কী পড়াতো, কিছুই মন দিয়ে শুনতাম না। শুধু বসে বসে ফোনে সার্চ করতাম ঢাকার কোথায় কিভাবে যেতে হয়, কোন বাসে যেতে হয়।
আমার সেই খামখেয়ালিপনা চোখে পড়েছিলো একজনের। আমাদের ব্যাচেরই। একদিন কোচিং শেষে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘তুমি ক্লাসে মন দাওনা ক্যান?’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কি জানো পুরান ঢাকায় কিভাবে যেতে হয়?’
ছেলেটার নাম তূর।
তূর শব্দের অর্থ পর্বত। মুসা (আঃ) তূর পর্বতের চূড়ায় উঠে পূরণ করতে চেয়েছিলেন তার জীবনের সব থেকে বড় ইচ্ছা- খোদার দর্শন। আর আমি তূর নামের ছেলেটার ওপর নির্ভর করে পূরণ করতে চাইলাম আমার জীবনের একটা ছোট ইচ্ছা- আমাকে দশমাস পেটে ধরা সেই মানবীর দর্শন।
আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিলো।
তূরের সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হলো। তূর খুব তুখোড় ছাত্র। ওর মতো ছেলে যে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে ভাববে, এটা আমি কল্পনাও করিনি। ও আমাকে শর্ত দিলো মন দিয়ে কোচিং করলে, ভালো করে পড়লে আমি যেখানে যেতে চাই, ও নিয়ে যাবে।
আমার জন্মপরিচয় পাওয়ার পর আমার পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিলো। ডুবে যাচ্ছিলাম এক অদৃশ্য চোরাবালিতে। তূর হঠাৎ করে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো। যে হাতটা ধরে আমি সেই চোরাবালি থেকে উঠতে পারব। পড়াশোনায় মনোযোগ এলো অনেকদিন পর। কষ্ট হতো, তবুও জোর করে পড়তাম।
তারপর এলো সেই সময়টা। তূর কথা রেখেছিলো। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পর আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো পুরান ঢাকায়। দুজন পুরো পুরান ঢাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করেছিলাম রঘু সাহার আড়ত। আঠারো বছর আগে যে বাড়িতে আমাকে পেটে নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রবেশ করেছিলো মহুয়া সাহা, সেই বাড়িতেই একই কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রবেশ করেছিলাম আমিও। রঘু সাহা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন দুই বছর। আমার পরিচয় পেয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। ও বাড়িতে গিয়ে শুনেছিলাম মহুয়া সাহার খুব ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছিলো এরপর। স্বামী সন্তান নিয়ে ধানমন্ডিতে তার এখন সুখের সংসার।
তূর আমাকে ধানমন্ডিতেও নিয়ে গেলো।
মহুয়া সাহার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। কে যেন অদৃশ্য শক্তিতে কেড়ে নিয়েছিলো আমার সমস্ত সাহস, সমস্ত শক্তি। তূর প্রথমবারের মতো আমার হাত ধরেছিলো সেদিন। কাঁধ ঝাকিয়ে বলেছিলো, ‘ভয় পাবিনা একদম, যা হবার হবে। তুই যা, আমি আছি এখানেই।’
কিসের ভয় পাবার কথা বলেছিলো তূর, আমি তখন বুঝিনি। এখন বুঝি। সত্যের মুখোমুখি হবার ভয়। আমি সেই ভয় কাটাতে পেরেছিলাম। মহুয়া নামের যে মধ্যবয়স্ক মহিলাটি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন, তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। হুবহু আমার চেহারা। একই চোখ, একই মুখের গড়ন, একই গায়ের রঙ।
চমকে উঠেছিলেন তিনিও।
চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমার তখন কী হয়েছিলো কে জানে! সমস্ত কান্না দলা বেঁধে গেলো গলার কাছে, চোখ ভরে গেলো এক সমুদ্র জলে। কোনোমতে শুধু বললাম, ‘আমি মুনিয়া’
তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন সাথে সাথে।
মাথায় পাগলের মতো হাত বুলিয়ে চুমু খেতে খেতে বললেন, ‘আমার মুনিয়া৷ আমার মুন। কত বড় হয়ে গেছে আমার মেয়ে’
আমি কেন তখন কাঁদছিলাম আমি জানিনা। কাঁদছিলেন তিনিও। যেন কত জন্মের কান্না জমে ছিলো তার বুকে। সব উজাড় করে কাঁদছিলেন।
এর পরের কাহিনি খুব সংক্ষিপ্ত।
মহুয়া সাহা যদিও এখন মহুয়া ঘোষ হয়ে গেছেন, তবুও আমি তাকে মহুয়া সাহাই বলবো। মহুয়া সাহা চেয়েছিলেন আমি যেন তার সাথে থাকি। কিন্তু এই উজ্জ্বল লাবণ্যময়ী চেহারা, দামী কাপড়চোপড় আর সিঁথিভর্তি সিঁদুরে রাঙা এই মহিলাটিকে মা ভাবতে পারিনি আমি। মা উচ্চারণ করলেই আমার চোখে ভাসে ফিরোজা রঙের সুতি শাড়ি পরা, গায়ে মশলার ঘ্রাণওয়ালা, খুব আটপৌরে শাহানাজ বেগমের চেহারা। আমার শান্তি মেলেনা কোথাও। আমি মহুয়া সাহাকে ছেড়ে চলে আসি তূরের কাছে। রিকশায় উঠে তূর আমার মাথাটা চেপে ধরে তার কাঁধে। আমি নিঃশব্দে কেঁদে যাই। তূর কোনো কথা বলে না। আমার চোখের জলে তূরের শার্ট ভিজে যায়। সেদিনই বুঝে যাই তূর আমার শুধু বন্ধু নয়। এর থেকে বেশি কিছু।
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল সেদিনই বের হয়।
তূরের চান্স হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আমার কোথাও হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। তূরের জন্য খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু খারাপ লেগেছিলো নিজের জন্য। এক মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো আলী হায়দার এর ক্লান্ত চেহারাটা। গোটা পৃথিবী ওই একটা দিনেই যেন আমার সহ্যশক্তির পরীক্ষা নিচ্ছিলো।
দুঃখ পরিমাপের কোনো একক নেই। থাকলেও সেদিন আমার দুঃখ পরিমাপ করা যেতোনা কোনো যন্ত্র দিয়েই। কিন্তু তূরের হাসিমুখের সামনে আমি আমি নিজের কষ্ট চাপা দিয়েছিলাম। সেই প্রথমবার আমি শিখেছি কিভাবে কষ্ট চেপে হাসতে হয়।
সেদিন মহুয়া সাহাকে আমি ছেড়ে এসেছিলাম। কিন্তু মহুয়া সাহা আমাকে ছাড়েননি। এরপর তিনি আমার সাথে বারবার যোগাযোগ করেন। আমাকে বলেন তার সাথে থাকতে। কিন্তু বারবার বলেও আমাকে রাজি করতে পারেননি তিনি। তবুও ছাড়লেন না আমাকে। একটা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করে দিলেন৷ হাতিরপুলে একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া করে আমাকে তুলে দিলেন। ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিলেন। গাড়ির ড্রাইভার এর নাম্বার দিলেন। যখনই কল দেবো, ড্রাইভার চলে আসবে গাড়ি নিয়ে। যখন ইচ্ছা, যতক্ষণ ইচ্ছা আমি গাড়ি ব্যবহার করতে পারবো। আমি সব গ্রহণ করলাম। বিনিময়ে মহুয়া সাহাকে শর্ত দিলাম, আমার সাথে আর কোনোদিন যোগাযোগ করবেন না তিনি।
আমি মুনিয়া। মুনিয়া হায়দার। আমার নামের শেষ অংশটুকু যার নাম থেকে নিয়েছি, সেই মানুষটার নাম আলী হায়দার। তাকে আমি আব্বা ডাকতাম। সারাজীবন যাযাবরের মতো অন্যের জায়গায় থেকে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। তার জীবনের একান্তই একটা স্বপ্ন ছিলো- তার একটা নিজের বাড়ি হবে। একদম নিজের একটা ঠিকানা হবে। আমি তাই তাকে কোনো টাকাপয়সার চাপ দিইনি কখনো। মাত্র ৩০ টাকা বাঁচাতে ৩/৪ কিলোমিটার হেঁটে কলেজ গিয়েছি রোজ। সেই বাঁচানো টাকায় বই কিনেছি, খাতা কিনেছি।
সেই আমি এখন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকি। চাইলেই এসি গাড়িতে করে ঘুরতে পারি যখন ইচ্ছা। আমার ব্যাংক একাউন্টে এখন মাসে মাসে হাজার হাজার টাকা ঢোকে। কিন্তু আমার শান্তি লাগেনা। কিছুতেই শান্তি লাগেনা।
আমি মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করেছি, উচ্চবিত্ত বিলাসী জীবনও যাপন করেছি। অথচ আমাকে বারবার টেনেছে ওই মধ্যবিত্ত জীবনই। প্রতিদিনের ওই তিরিশ টাকায় যে তৃপ্তির গন্ধ থাকতো, তা এই হাজার হাজার টাকায় আমি পাইনা।
আমার একমাত্র শান্তি মেলে শুধু তূরের কাছে গেলেই। শান্ত নদীর মতো একটা ছেলে। তূরের সাথে আমার সম্পর্কটা অমিমাংসিত।
প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, বন্ধুত্বও নয়। আমার নিজেকে মনে হয় আমি দিকহারা এক নাবিক। আর তূর একটা বিশাল পর্বত। আমি সেই পর্বত এর দিকে ছুটে চলেছি দিক খুঁজে পেতে।
কিন্তু আমি বুঝিনি। বুঝিনি অনেক কিছুই। মুসা (আঃ) তূর পর্বতে উঠে খোদাকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খোদার দর্শন পাওয়ার আগেই খোদার তীব্র দীপ্তিতে পুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছিলো তূর পর্বত।
আমি দেখতে চাচ্ছিলাম তূরকে। তূরের ভেতরে যদি চাপা কষ্ট কিছু থেকে থাকে, তার ভাগিদার হতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তূরের তীব্র দীপ্তিতে পুরে ভস্ম হয়ে গেলাম আমিও।
তূর ছিলো তুখোড় মেধাবী একটা ছাত্র। চান্স হয়েছিলো ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ভর্তি হয়েই উঠে গেলো মেডিকেলের হলে। আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়লো রাজনীতিতে। আমি পছন্দ করতাম না বলে আমাকে বলতো, ‘তোরও উচিত রাজনীতিতে আসা। আমাদের মতো মানুষেরা যদি রাজনীতিতে না আসে, তাহলে রাজনীতির পরিবেশ ভালো হবে কী করে?’
তূরের সাথে দূরত্ব বাড়ছিলো আমার।
এটা স্বাভাবিক। তূরের জীবন অনেক ব্যস্ত। ক্লাস, প্রাক্টিক্যাল, টিউশন, পলিটিক্স, হললাইফ। আমার জীবনে কিছুই নেই। ক্লাসে যাই, আসি। মহুয়া সাহার টাকায় থাকি, মহুয়া সাহার টাকায় খাই। বুয়া নিজে বাজার করে এনে রান্না করে দিয়ে যায়। কোনো ঝামেলা নেই। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো। আর আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে।
মাঝে মাঝে ট্যাপা ফোন করে। জানায় মা কাঁদে। আব্বা হাসে না। বলে ‘আপা তুমি বাড়ি আসো’
আমি হু হা বলে ফোন কেটে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদি।
এত অভিমান সৃষ্টিকর্তা কেন দিয়েছেন আমাকে? আমি পারিনা অভিমান ভেঙে বাড়ি যেতে। ইগোতে লাগে। এত ইগো! হায়রে!
তূরকে কল দিই। তূর নানান বাহানায় এড়িয়ে যায়।
একা একা হেঁটে বেড়াই। হাতিরপুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, তূরের হল, আরেকটু এগিয়ে চানখারপুল, সোজা হাঁটতে হাঁটতে পুরান ঢাকার অলিগলি, রঘু সাহার বাড়ির গেট, চালের আড়ত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সদরঘাট। পা চলেনা, কিন্তু হাঁটতেই থাকি।
এরমধ্যে তূর একদিন কল দিলো। দেখা করলাম। শনিবার বিকেলে।
তূর সেদিন পরে এসেছিলো একটা মেরুন রঙের চেকশার্ট। চুল এলোমেলো। চেহারা বিদ্ধস্ত। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘুমাস নাই রাতে?’
তূর উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। কী ছিলো ওই চাহনিতে, আমি বুঝিনা এখনও। তারপর একটু হেসে বললো, ‘তোর চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে তুই এক সপ্তাহ ধরে ঘুমাস না।’ কিছুক্ষণ পর গলা নরম করে বলেছিলো, ‘তুই বাড়ি চলে যা মুনিয়া। আঙ্কেল আন্টি নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছেন তোর জন্য। একবার যা, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। একদম আগের মতো হয়ে গেছে।’
তূরের কন্ঠে এত দরদ ছিলো, আমার চোখে পানি এসে গেলো।
তূর জিজ্ঞেস করলো, ‘কবে যাবি বল। আমি পঞ্চগড় গিয়ে দিয়ে আসব দরকার হলে।’
তূর আমার থেকে কথা নিয়েই ছাড়লো যে আমি বাড়ি ফিরে যাবো। এরপর অনেকক্ষণ ছিলাম আমরা একসাথে। কতশত গল্প!
দ্বিতীয়বারের মতো তূর আবার সেদিন হাত ধরলো আমার। দুজন হাঁটলাম অনেক। হাত ধরে। কতদিন পর একটু ভালো সময় গেলো আমার!
রাত দশটার দিকে তূর আমাকে আমার বাসার নিচে রেখে গেলো। যাওয়ার আগে খুব ইতস্তত করে বলেছিলো, ‘তোকে একটা কথা বলা উচিত, বুঝতে পারছি না বলব কিনা’
আমার হাত তখনও তূরের হাতের মুঠোয়। আমার চুলে তূরের গুঁজে দেয়া বাগানবিলাস। আমার পেটের ভেতর একশ একটা রঙিন প্রজাপতি। আমি লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললাম, ‘বল, কী বলতে চাস?’
আমি তূরের দিকে তাকাইনি তখন ভালো করে। তাকালে হয়তো দেখতাম তূরের চোখে দ্বিধা, কোনো একটা ভয়। কিন্তু আমি কিছুই খেয়াল করিনি। তূর আমার খুশি খুশি চেহারার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমার মাথায় আলতো করে একটা চাঁটি দিয়ে বললো, ‘থাক, পরে বলবো। বাসায় যা।’
শনিবার বিকেলে দেখা হলো আমাদের। রাত দশটা পর্যন্ত একসাথে থাকলাম। রবিবার সারাদিন তূরের ফোন বন্ধ। বুঝলাম ব্যস্ত আছে হয়তো। সোমবার ভোররাতে একটা লাশ ভেসে উঠলো বুড়িগঙ্গা নদীতে। গায়ে মেরুন রঙের চেকশার্ট। আমি খবরটা দেখলাম সকাল দশটা তের মিনিটে। ফেসবুকে ঢুকেই আমার হাত থমকে গেলো। ফেসবুক ভর্তি একটা ছেলের ছবি। পানিতে থেকে থেকে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শরীর ফুলে উঠেছে। গায়ের শার্টটা আমার চেনা। আমার তূর!
আমার পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো আরেকবার। কাঁদার কথাও যেন ভুলে গেলাম। বিশ্বাস করতে চাইলাম না এটা তূর।
কাঁপা কাঁপা হাতে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম সবগুলো নিউজ চ্যানেল। আমার তূর এখন ব্রেকিং নিউজে। পুরো দেশব্যাপী তূরের মৃত্যু সংবাদ। কেঁদে উঠলাম হাউমাউ করে। চোখে শ্রাবণের ঢল।
সোমবার রাতেই তূর হত্যার দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করলো আমাকে।
পুলিশের হাতে সমস্ত প্রমাণ আছে। তূরের ফোনে শেষ কলটা আমার। রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায় তূর হাঁটছে আমার হাত ধরে। তূরের সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছে যে ব্যক্তির, সেটা আমি। সমস্ত প্রমাণ তাদের সামনে। আমার কোনো অভিভাবক নেই। একা একা একটা ফ্ল্যাটে থাকি। মা নেই, বাবা নেই। কাজেই আমাকে গ্রেফতার করা সহজ।
পরদিন সবগুলো নিউজ পেপারে রগরগে হেডলাইন বের হলো, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র তূরের নির্মম মৃত্যু। খুনের দায়ে গ্রেফতার প্রেমিকা মুনিয়া হায়দার।’
আমাকে নেয়া হলো শাহবাগ থানায়। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ হলো। কোর্টে নেয়া হলো কয়েকবার। থানাও বদল করা হলো বেশ কয়েকবার। একসময় প্রমাণিত হলো আমি নিরপরাধ। কিন্তু বাংলাদেশের আইন আর বিচারবিভাগ এর দীর্ঘসূত্রতার কারণে জামিন হচ্ছিলো না।
আমার দিন কাটছিলো কোনো একটা থানার ২৯ নম্বর সেলে।
আমি সারাদিন শুধু ভাবি। নিজের কথা। আব্বার কথা। মার কথা। ট্যাপার কথা। তূরের কথা। তূর সেদিন কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো আমাকে। ও নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছিলো ওর জীবন আশংকায় আছে। আমি বুঝতে পারিনি। যদি বুঝতাম, সেদিনই জোর করে শুনে নিতাম। ভাবি, আর কাঁদি। এত চোখের পানি ফেলি, তবু চোখ শুকায় না।
ভাবি আমার জামিন হলে আমি কোথায় যাবো। হাতিরপুল এর সেই ফ্ল্যাটটায় বোধহয় আর উঠতে পারবনা। বাড়ি যে ফিরে যাবো, সেই মুখটাও নেই। অথচ আমি তূরকে কথা দিয়েছিলাম বাড়ি ফিরবো। তূর আমার বাড়ি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো। Shawshank Redemption নামে একটা মুভি আছে। সেই মুভিতে ব্রুকস নামে একটা চরিত্র আছে। ব্রুকসের সারাটা জীবন কাটে জেলের ভেতর। সে দিন গুণতো কবে জেল থেকে ছাড়া পাবে। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর দেখা যায় তার আসলে কোথাও যাওয়ার নেই। কিচ্ছু করার নেই। শেষে একদিন সে ঝুলে পড়ে ফ্যানের সাথে।
আমার মনে হয় আমারও তাই হবে। আমি ছাড়া পেয়ে দেখবো আমার সামনে পুরো দুনিয়াটাই আছে। কিন্তু আমার যাওয়ার জায়গা নেই কোথাও। হয়তো হাঁটতে হাঁটতে যাব বুড়িগঙ্গায়। তূরকে যেখানে পাওয়া গেছে, লাফ দেবো ঠিক সেখানেই।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।
যেদিন আমার জামিন হলো, আমি বের হয়ে দেখি জেলগেটে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। আমার জন্য। মানুষটার গায়ে সাদা পাঞ্জাবী, আতরের ঘ্রাণ। চেহারায় বয়সের ছাপ। দাড়ি প্রায় সবগুলোই পেকে গেছে। মানুষটাকে দেখে আমার হঠাৎ অন্যরকম এক কষ্ট হয়। তূরকে হারিয়ে যেভাবে কেঁদেছিলাম, তার থেকেও বেশি জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। পুরো শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে। মানুষটা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে আমাকে ধরে।
এই মানুষটা ১৯৯৯ সালে একবার আমাকে কোলে নিয়ে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী ট্রেনে উঠেছিলেন। আবার ২০২৪ সালে আমাকে নিয়ে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী ট্রেনে উঠলেন। গন্তব্য পঞ্চগড়ের একদম প্রত্যন্ত একটা উপজেলা। সেখানে আমাদের একটা বাড়ি হয়েছে। টিনশেডের দোতলা বাড়ি। আমাদের নিজস্ব বাড়ি।
আমি ভেবেছিলাম আমার হয়তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর। কিন্তু দুনিয়ার সমস্ত জায়গা নিয়ে দুইজন মানুষ অপেক্ষা করে ছিলেন আমার ফেরার। সেখানে আমার নাড়ির টান নেই। কিন্তু আব্বার হাত ধরে শাহানাজ বেগম নামে এক নারীর টানে আমি ফিরছি আবার সেখানে। সাত বছর পর। সেই নারী আমাকে শিখিয়েছিলো তাকে এমন একটি শব্দে ডাকতে, যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ- ‘মা’
১৬ জুন, ২০২৫