সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়েছে ৩৩ গুণ

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৩ গুণের বেশি। ২০২৪ শেষে দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার সুইস ফ্রাঁ। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ফ্রাঁ ১৫০ টাকা) হিসাব টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা।

২০২৩ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৭৭ লাখ ১৩ হাজার সুইস ফ্রাঁ। বর্তমান বিনিময় হার ধরলে যার পরিমাণ ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৩৩ দশমিক ২৮ গুণ। টাকার হিসাবে বেড়েছে ৮ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।

২০২২ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৮৭৬ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ২০২৪ সালে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।

এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে অবশ্য বাংলাদেশিদের টাকা জমার উলম্ফনের কোনও কারণ উল্লেখ করেনি এসএনবি। পাচার সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি আমানত হিসাবে কার কত অর্থ আছে, তা-ও জানা যায়নি। কখনই এ তথ্য প্রকাশ করে না এসএনবি।

এসএনবির প্রতিবেদনে ১০ বছরের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা ছিল ২০২১ সালে; ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁ।

সে সময়কার বিনিময় হার (১ সুইস ফ্রাঁ =৯৫ টাকা ৮০ পয়সা) হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।

২০১৮ থেকে ২০২০ সাল, পরপর তিন বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমার পর ২০২১ সালে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়। ২০২২ সালে তা এক ধাক্কায় কমে ৫ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার সুইস ফ্রাঁতে নেমে আসে।

২০২৩ সালে তা আরও কমে এক কোটি ৭৭ লাখ ১৩ হাজার ফ্রাঁতে নেমে আসে। ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি সবচেয়ে কম অর্থ জমা ছিল।

সবশেষ ২০২৪ সালে তা ফের বেড়ে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ফ্রাঁতে উঠেছে।

২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার সুইস ফ্রাঁ। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁতে ওঠে।

২০১৭ সাল শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০১৮ সাল শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০১৯ সালে আরও খানিকটা কমে দাঁড়ায় ৬০ কোটি ৩০ লাখে। ২০২০ সাল শেষে নেমে আসে ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মতো সুইস ব্যাংকে ভারতীয় নাগরিকরাও বেশি অর্থ জমা করেছেন। ২০২৪ সাল শেষে সুইস ব্যাংকে ভারতীয় নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ ৩৫০ কোটি ৪২ লাখ ৪৬ হাজার সুইস ফ্রাঁ।

২০২৩ সালে ব্যাংকটিতে ভারতীয়দের জমা ছিল ১০২ কোটি ৯৮ লাখ ৪৪ হাজার সুইস ফ্রাঁ; ২০২২ সালে ছিল ৩৪০ কোটি ২ লাখ ৬১ হাজার ফ্রাঁ।

২০২০ সাল শেষে ব্যাংকটিতে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ২৫৫ কোটি ২৬ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২১ সালে তা ৫০ শতাংশ বেড়ে ৩৮২ কোটি ৮৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়। ২০১৯ সালে ছিল ৮৯ কোটি ৯০ লাখ।

পাকিস্তানের নাগরিকদের জমা অর্থির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ২০২৩ সালে ছিল ২৮ কোটি ৫৭ লাখ ৬৬ হাজার ফ্রাঁ। ২০২৪ সালে তা কমে ২৭ কোটি ১৬ লাখ ৭৩ ফ্রাঁতে নেমে এসেছে।

২০২৪ সাল শেষে সুইস ব্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জমা ছিল ৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৩ হাজার সুইস ফ্রাঁ। ২০২৩ সালে ছিল ৭ হাজার ১০০ কোটি ৮১ লাখ ৯১ হাজার ফ্রাঁ।

সাধারণত সুইস ব্যাংক অর্থের উৎস গোপন রাখে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন।

সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয় বা টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। এই গোপনীয়তার নীতির কারণে সারা বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন।

তবে কোন দেশের গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে, তার একটি ধারণা প্রতি বছর এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি ওই তথ্য প্রকাশ করে। তবে সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না।

দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা জমা রয়েছে, তার বেশিরভাগই অবৈধভাবে অর্জিত।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অর্থের পরিমাণ প্রথমবার ১০ কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক ছাড়িয়ে যায় ২০০৬ সালে, যেটি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর।

৯ কোটি ৭২ লাখ সুইস ফ্রাঁ থেকে বেড়ে ওই বছর জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছর ২০০৭ সালে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে জমার পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ, তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৬৬ কোটি ১৯ লাখে।

২০১৭ সালে জমা কমে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে নেমে এলেও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছরে তা বেড়ে ৫১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে দাঁড়ায়।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *