■ হিন্দোল পন্ডিত ■
বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২
আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগের ঘটনা। বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা ৭টা ২০। গোবরডাঙ্গা স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে থামল আপ বনগাঁ লোকাল। ট্রেন থেকে নামলেন মিত্র ইনস্টিউশনের বাংলার শিক্ষক। তিন নম্বর থেকে এক নম্বর প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলেন। স্টেশনের বাইরে বাইক রাখা। অন্যদিন স্টেশনে তাঁকে নিতে আসেন অনেক বন্ধু। কারণ গ্রামের সকলের এই শিক্ষকের নিরাপত্তা নিয়ে খুব চিন্তা। তাই মাস্টারমশাইকে একা চলাফেরা করতে দিত না তাঁর তরুণ অনুরাগীরা। কিন্তু আজ গ্রামে একটি বিয়ে তাই মাস্টারমশাই স্টেশনে কাউকে আসতে বারন করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি জানতেন না বেশ কয়েক জোড়া চোখ তক্কে-তক্কে অপেক্ষা করছিল কবে মাস্টারমশাইকে একা পাওয়া যায়। সুযোগ এসে গেল আজ। এক নম্বর প্লাটফর্ম থেকে বেরোনোর পর নিজের বাইকে উঠতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় মাস্টারমশাইয়ের পিছন দিক থেকে কারা যেন পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দিল। দুটি বুলেট, প্রথমে পিঠে তারপর বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মাস্টারমশাই। প্রায় আধঘন্টা ওই স্টেশনে রক্তে মাখামাখি হয়ে কাতরেছেন। যতক্ষন মাস্টারমশাইয়ের দেহে প্রাণ ছিল বলছিলেন, আমায় বাঁচাও। না কেউ আসেনি। অনেক পরে খবর পেয়ে ছুটে আসে তাঁর লোকেরা। রক্তক্ষরণ হচ্ছিল ক্রমাগত। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু যতক্ষণে শিক্ষককে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, ততক্ষণে আর কিছু নেই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনি।
পরের দিন মানে ছয় জুলাই। ভারী বর্ষা। সব ভুলে স্থানীয় মাঠে জমায়েত হয়েছিল হাজার, হাজার মানুষের। সবাই মাস্টারদাকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানাতে চায়। তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে থাকা স্থানীয় মহিলারা হাতে তুলে নিয়েছিলেন হাতা, খুন্তি, ঝাঁটা। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি।
প্রধান সড়ক বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো প্রায় ১০ ঘণ্টা। ৪০ হাজার লোক এসেছিলো তাঁর অন্তিম যাত্রায়। শব ছুঁয়ে শপথও নিয়েছিল অনেকে, তারা পণ করেছিল এই হত্যার জন্য দায়ী সকলের শাস্তি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার। সময়ের সাথে তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তাঁর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট নন পরিবারের সদস্যরা।
কেন মারা গেলেন মাস্টারদা? জেলে বসে সুশান্তই কি মারল? নাকি মাটি-মাফিয়া? নাকি আরো কোন বড় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? আজও কেন নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি এই হত্যাকাণ্ডের? আমাদের দেশে এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, আমরা জানি। আজ ঘটনার দশ বছর বাদেও প্রকৃত দোষীরা সাজা পাননি। বনগাঁ মহকুমা আদালতে আজও সে মামলা চলছে । ভালো থাকুন বরুন বিশ্বাস। বিশ্বাস থাক। বিশ্বাস বাঁচুক। ভালো থাকুন আদর্শ। মাস্টারদার মৃত্যু নেই। বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। সত্যি আজকালকার দুনিয়ায় এমন মানুষও হয় ! প্রণাম।
কে এই মাস্টারদা ? কেনই বা অকালে চলে যেতে হল তাঁকে ?
উত্তর খুঁজতে চলে যেতে হবে বেশ কয়েকটা দশক। সুটিয়া। উত্তর চব্বিশ পরগনার একদম প্রান্তিক গ্রাম। একঘণ্টা হাঁটলেই বাংলাদেশ সীমান্ত। সুটিয়ার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ইচ্ছামতী, যমুনা। একাত্তরের পর থেকে ওপার বাংলা থেকে এসেছে মানুষের ঢল। প্রতি বছর বর্ষাতে সুটিয়া ভেসে যায়। সরকারি , বেসরকারি রিলিফ ফান্ড আসে। এই রিলিফ ফান্ডের দখলদারি নিয়েই উত্থান সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালিদের। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং লোকাল লুম্পেনকে পাশে নিয়ে এরা দখল করলেন সুটিয়ার ত্রাণ তহবিল। হুমকি, মারধোর, বাইক বাহিনী। নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকে সুটিয়ার নতুন পরিচয় -ধর্ষণ নগরী। ১৯৯০ থেকে ২০০২, সুঁটিয়া এবং তার আশপাশের গ্রামগুলোতে তান্ডব চালিয়েছিল সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালিদের দল। প্রতি পরিবারের প্রত্যেক নারীর উপরে নেমে এসেছিল বিষাক্ত ছোবল। চলতো ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল। এমনকি পরিবারের সদস্যদের সামনেই চলেছে যৌন নিপীড়ন। ধর্ষণের পর যোনিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হত বরফ টুকরো। নগ্ন দেহের ছবি তোলা হত। পরে এ ছবি দেদার বিকোবে। কারুর টু শব্দটি করার সাহস ছিল না। পুলিশ অভিযোগ নিত না। হইহই করে বাড়ছিল হায়নার দল। ছিল দাদাদের অভয় বাণী, যে মেয়েকে ইচ্ছে, তাকে তুলে নিয়ে আয়। নিয়ে চল সুখ সাধুর ভিটেতে। সেখানে মজুত অফুরন্ত মদ ও ক্যামেরা। গ্রামে যেকোন বিবাদ- সম্পর্ক জনিত, জমি বা অর্থকরী সংক্রান্ত- নিদান একটাই, ধর্ষণ। অনেক সময় লাঞ্ছিতা মেয়েটিকে তারা বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যেত। মেয়েটির মা’কে বলে যেত, মেয়েটিকে তাদের মনে ধরেছে। যেন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। পরের দিন আবার নিয়ে যাবে । বাড়িতে বাড়িতে গুন্ডাদের দূতেরা বলে আসত “মেয়ে পাঠিয়ে দেবেন , না হলে সব জ্বালিয়ে দেব। ” দুহাজার থেকে দুহাজার তিন অবধি শুধু পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ধর্ষণের সংখ্যাটি ছিল তেত্রিশ। স্থানীয়দের মতে, আসল সংখ্যাটি অনেক গুন।
ঠিক তখনই কলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউটে সদ্য চাকরি পাওয়া ২৬ – ২৭ বছরের ছিপছিপে গড়নের এক যুবক সুটিয়া বাজারের চৌরাস্তার মোড়ে বৃষ্টি ভেজা এক সন্ধ্যায় মাইক্রোফোন ধরে বলা শুরু করেন “আমরা যদি আমাদের মা বোন মেয়ের সম্মান ক্রিমিনালদের হাত থেকে না বাঁচাতে পারি, আমরা ক্রিমিনালদের থেকে বেশি অপরাধী। “সুটিয়া শুনল প্রথম প্রতিবাদের ভাষা । প্রথম একটা শিরদাঁড়া জানান দিল , ব্যাস অনেক হয়েছে , আর নয় অন্যায় এবার ন্যায় চাই । সেই দিনের সেই শিরদাড়ার নাম বরুন বিশ্বাস, আমাদের বরুন দা। একটা প্রতিবাদের সূর্যোদয়। একটা বরুন যখন জেগে উঠল মানুষের ভিতর নিভে যাওয়া আগুন আবার জ্বলে উঠল।
১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সুটিয়ায় বরুণ বিশ্বাসের জন্ম। বাবা- জগদীশ বিশ্বাস ও মা- গীতা বিশ্বাস। বরুণ বিশ্বাস পাঁচপোতা ভরাডাঙা হাই স্কুল ও খাতরা বয়েজ হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও নিউ ব্যারাকপুরের বি. টি. কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন। ফরিদপুর থেকে এসছিল তাঁর পরিবার । শরীরে দুর্মর বাঙাল রক্ত। নইলে ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়েও কেউ সে চাকরি ছেড়ে দেয় ? বা দিব্যি তো ছিলেন মিত্র ইনষ্টিটিউশনে, বাংলার শিক্ষক হয়ে। পারতেন কলকাতায় শিফট করতে, এই পাপ নগরী থেকে দূরে থাকতে। আমি-আপনি তাই-ই করতাম । কিন্ত তিনি যে মাস্টারদা।
নিজের উদ্যোগে মাস্টারদা তৈরি করলেন সুঁটিয়া ধর্ষণ বিরোধী মঞ্চ। পাশে পেলেন বেশ কিছু উৎসাহী ছেলেমেয়েকে। সরকারের উপর মহলে লিখলেন একটার পর একটা চিঠি । ধর্ষিতা মেয়েদের বিয়ে দিলেন । নেকড়ের পালরা কামড়াতে এলে গড়ে তুললেন পাল্টা প্রতিরোধ। রাতের পর রাত বাইকে টহল দিতেন গোটা গ্রাম। তাঁর বাইকের আওয়াজে গোটা গাঁ নিশ্চিন্তে ঘুমোত।
যে ঘরে মাস্টারদা থাকতেন, তাতে একটা খাট আছে। গদি নেই, প্ল্যস্টিক পাতা। এলাকার ছাত্রছাত্রীদের বই, খাতা, পেন, পেন্সিল কিনে দিতেন। যথেষ্ট রোজগার করলেও টাকাপয়সা কিস্যু জমতো না। রোজ ঘন্টা দুয়েকের জার্নি করতেন রাতটা গ্রামে কাটাবেন বলে। জবা ফুল বড্ড প্রিয় ছিল মানুষটার। ছিলেন প্রত্যেকের ঘরের ছেলে। কার বই কেনা হয়নি, কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না পয়সার অভাবে, কে রাতে বিছানার অভাবে ঘুমাতে পারছে না, কার ওষুধ চাই, কার কলেজে ভর্তি হতে হবে, বরুন দা সবই জানতেন। আর সবার মুশকিল আসানও দাদাই।
মাস্টারদার একটার পর একটা চিঠি শেষমেষ সরকারের টনক নড়িয়ে দেয়। সিআইডি তদন্ত হলে গ্রেফতার হয় সুশান্ত, বীরেশ্বরসহ আরো অনেকে। মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এদের। একজন অভিযুক্তের হাতে নাকি বরুন তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’। বলেছিলেন “জেলে বসে পড়িস।” ভাবা যায় ! গোটা গাঁ নিশ্চিন্তে হাফ ফেলল। কিন্ত তিনি বরুণ বিশ্বাস, তাঁর লড়াই এতেই শেষ নয় ।
মাস্টারদা লক্ষ্য করছিলেন, প্রতি বছর গ্রামে বন্যা হয়। কারণ কি ? জানা গেল, ভাটার সময় কেটে নেওয়া হয় মাটি। মাটি-মাফিয়ারা সেই মাটি পাঠিয়ে দিচ্ছে চড়া দামে। ফলে বর্ষাকালে অবশ্যম্ভাবী বন্যা। নতুন বাঁধ, নতুন রিলিফ ফান্ড, নতুন ঠিকাদার-একটা বিরাট, সংঘটিত অপরাধ চক্র। এর বিরুদ্ধে বরুণ শুরু করলেন তাঁর আন্দোলন। নদী চোরেরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বরুন বেঁচে থাকলে তাদের সব ব্যবসা লাটে উঠবে , ভালো করে বুঝে গিয়েছিল। বারবার হুমকি আসছিল বরুনদার কাছে। কিন্তু আমাদের বরুন দার চোখে ভেসে উঠত বন্যায় সর্বস্ব হারানো মানুষগুলির চেহারা, বরুন দা ভয় পান নি। তার কাছে মানুষগুলি অনেক বেশি দামী ছিল, আর নিজের জীবন অনেক কম। বরুন দার নদী আন্দোলন দিকে দিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।
দুষ্কৃতিকারী বুঝে গিয়েছিল বরুণ বিশ্বাসকে চিরতরে সরিয়ে না দিলে তাদের কার্যসিদ্ধি অসম্ভব। আর সেই কারণেই মাস্টারদাকে গোবরডাঙ্গা স্টেশনে হত্যা করা হয়েছিল । ২০১৬ সালের ৩০ জুন ভোররাতে হাবরা, গাইঘাটা ও গোপালনগর থানার পুলিশ অপরাধী চক্রের পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ছিল অভিযুক্ত ভাড়াটে খুনি সুমন্ত দেবনাথ ওরফে ফটকে, দেবাশিষ সরকার, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ও রাজু সরকার। এদের বেশিরভাগই স্থানীয় দুষ্কৃতি। এরা পুলিশের কাছে স্বীকার করে যে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী সুশান্ত চৌধুরীর নির্দেশে তারা বরুণ বিশ্বাসকে খুন করেছে। ভাড়াটে খুনিরা ধরা পড়লেও কার বা কাদের অর্থে ও নির্দেশে এ খুন, তার আলোকপাত নেই সিআইডি’র চার্জশিটে। এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে নাম জড়িয়েছে এক বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তির। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে হয়নি কোনও তদন্ত।
কেন মারা গেলেন মাস্টারদা? জেলে বসে সুশান্তই কি মারল? নাকি মাটি-মাফিয়া? নাকি আরো কোন বড় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? আজও কেন নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি এই হত্যাকাণ্ডের? আমাদের দেশে এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, আমরা জানি। আজ ঘটনার দশ বছর বাদেও প্রকৃত দোষীরা সাজা পাননি। বনগাঁ মহকুমা আদালতে আজও সে মামলা চলছে ।
ভালো থাকুন বরুন বিশ্বাস। বিশ্বাস থাক। বিশ্বাস বাঁচুক। ভালো থাকুন আদর্শ। মাস্টারদার মৃত্যু নেই। বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সত্যি আজকালকার দুনিয়ায় এমন মানুষও হয় !
প্রণাম।