■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৮ জনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ৪৯২ জন রোগী। চলতি বছরে এক দিনে এটি সর্বোচ্চ সংক্রমণ। এসব রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫৪ জন ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে।
সোমবার (৭ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন করে বরিশাল বিভাগে ১৫৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫১ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ৬৯ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে (ডিএনসিসি) ৩৬ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে (ডিএসসিসি) ৫৩ জন, খুলনা বিভাগে ৫৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬১ জন, রংপুর বিভাগে ৩ জন এবং সিলেট বিভাগে একজন ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৬৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১১ হাজার ৪০৯ জন।
দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪ হাজার ৩৪৫ জন। তবে জুন মাসেই এর চেয়ে বেশি মানুষ এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন; এ সংখ্যা ৫ হাজার ৮০৪। সরকারি হিসাব বলছে, এযাবৎকালের মধ্যে এক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে জুনে। আর চলতি জুলাই মাসের শুরু থেকেই সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে।
মশাবাহিত এ রোগে চলতি মাসে মৃত্যু হলে ছয়জনের। ১৯ জনের প্রাণ গেছে আগের মাসে। এছাড়া জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিন জন, এপ্রিলে সাত জন ও মে মাসে তিনজন ডেঙ্গুতে মারা যান। ফেব্রুয়ারি মাসে কারো মৃত্যুর তথ্য দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হন ২৪৬৭ জন। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১৭৭৩ জন এবং জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৯৫১ জন রোগী।
বুলেটিনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি নতুন রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে, ১৫৪ জন।
দেশে ২০২৪ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর মৃতের সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
গত বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১০৫৫ জন, মারা যান ১৪ জন; ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন, মারা যান ৩ জন; মার্চে ভর্তি ৩১১, মৃত্য ৫; এপ্রিলে ভর্তি ৫০৪, মৃত্যু ২; মে মাসে ভর্তি ৬৪৪, মৃত্যু ১২; এবং জুনের প্রথম ২৭ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৪৯০ জন এবং পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল। সব মিলে গত বছরের ২৮ জুন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিন হাজার ৫৪৭ জন এবং মারা যান ৪৩ জন।
অন্যদিকে চলতি জুনের ২৮ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত পাঁচ হাজার ১৩৯ জন ও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত মে মাসে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এক হাজার ৭৭৩ জন এবং মারা যান তিনজন; এপ্রিলে ভর্তি হয় ৭০১ জন এবং মারা যায় সাতজন; মার্চে ৩৩৬ জন ভর্তি হলেও কারও মৃত্যু হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি হন ৩৭৪ জন ও তিনজনের মৃত্যু হয়, জানুয়ারিতে ভর্তি হন এক হাজার ১৬১ জন এবং ১০ জনের মৃত্যু হয়। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত মৃত্যুর মিছিলে ৪১ জনের নাম যুক্ত হয়েছে।
গত দুই দশকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুলাইয়ের শেষে কিংবা আগস্টের শুরু থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তবে এ বছর জুনের শুরুতেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বাইরে থেকে বেশি আসছে সংকটাপন্ন রোগী। বরিশাল ও বরগুনায় রোগীর বিপরীতে পর্যাপ্ত শয্যা সংকটের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রোগীদের অভিযোগ, স্যালাইন ও ওষুধের সংকট রয়েছে। প্লাটিলেট সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, মশক নিধন কার্যক্রম প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। এ জন্য ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। একা কোনো সংস্থার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভাইরাসটি প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে কর্মসূচি নেওয়া দরকার। তবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে একলাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭০৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৮৬৮ জনের। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৮ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গিয়েছিল, শুধু ২০২৩ সালেই তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে।
দেশের প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়।
২০০০ সালের পরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু ধীরে ধীরে কমে এলেও ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ। ২০১৯ সালে ১ লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
২০২০ সালে করোনার প্রকোপের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়।
ঢাকার তুলনায় এর বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল দ্বিগুণের বেশি। সারা দেশের মৃত্যুর ৫৮ শতাংশই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের।