■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
গত ১৭ বছরের মধ্যে এবারই মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী পাস করেছে। ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশে। এবার ফেল করেছে প্রায় ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুর ২টায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির।
লতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ শিক্ষার্থী পাশ করেছেন। এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাশের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৮৩.০৪ শতাংশ।
এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। অর্থাৎ এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ উভয়ই কমেছে। এর মধ্যে জিপিএ-৫ কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭টি।
এবারের ফলাফল সম্পর্কে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, ‘এটি ফলাফল বিপর্যয় নয়, বরং যারা পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিয়েছে তারা ভালো করেছে। সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা নিতে হবে, সেভাবে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নকলমুক্ত পরিবেশে মানসম্মত পরীক্ষা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে—আর পড়ালেখা না করে হলে এসে পরীক্ষা দিয়ে পাস করা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে হয়তো খাতা দেখায় শিথীলতা ছিল। কিন্তু এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থী যা প্রাপ্য তা ই যেন সে পায় এবং আমরা তা ই দিয়েছি।’
ফল ঘোষণার সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও সমমান পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা যে নম্বর প্রাপ্য, তাই পেয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ওভারমার্কিং বা আন্ডারমার্কিং ক্ষতিকর। এ বছর যেসব শিক্ষক খাতা কেটেছেন, তাদের এমন (ওভারমার্কিং বা আন্ডারমার্কিং করার) কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এ বছর ওপর মহল থেকে আমাদের ওপর বিশেষ কোনো নির্দেশনা ছিল না। আমরাও শিক্ষকদের সে নির্দেশনা দিয়েছি। আমরা বলেছি, আপনারা শিক্ষক। আপনারা জানেন, কোন উত্তরটি পূর্ণ নম্বর পাবে আর কোনটি শূন্য পাবে। যা প্রাপ্য তা দেবেন। যা প্রাপ্য নয়, তা দেবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এবারের পরিসংখ্যানে কোনো কৃত্রিমতা বা কঠোরতা নেই। তাছাড়া ওভারমার্কিং বা আন্ডারমার্কিং অন্যায্য। এতে বৈষম্য হয়। যার পাওয়ার কথা নয় এবং যার পাওয়ার কথা, দুজনই এক হয়ে যায়। অনিয়মের কারণে দৃশ্যত ভালো-মন্দ এক হয়ে যায়। তবে বাস্তবে পার্থক্য থেকে যায়। পরে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় এটা প্রভাব দেখতে পাই।’
চলতি বছরের ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এতে ৩০ হাজার ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন শিক্ষার্থী ৩ হাজার ৭১৪টি কেন্দ্রে অংশ নেয়।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এদিন দুপুর ২টায় এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রতিটি শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রকাশ করা হয়।
দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাজশাহী বোর্ড। এ বোর্ডে পাশের হার ৭৭.৬৩ শতাংশ। আর সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে পাশের হার ৫৬.৩৮ শতাংশ।
৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাশের হার ৬৮.০৪ শতাংশ।
এদিকে চলতি বছরের দাখিল পরীক্ষায় ১ লাখ ৯৫ হাজার ১১৫ জন শিক্ষার্থী পাশ করেছে। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন। দাখিলে ৬৮.০৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। গতবার এই হার ছিল ৭৯.৬৬ শতাংশ। এবার দাখিলে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৬৬ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১৪ হাজার ২০৬ পরীক্ষার্থী। এবার দাখিলে পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে।
অন্যদিকে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল শাখায় পাশের হার ৭৩.৬৩ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন। গতবার এই পাশের হার ছিল ৮১.৩৮ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৯৪৮ জন।
গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৭৮ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ এবার এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল শাখায় পাশের হার কমেছে, তবে জিপিএ-৫ বেড়েছে।

ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৬৭.৫১ শতাংশ। এবার এ বোর্ডের মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার ৬৮ শিক্ষার্থী। গতবার এই বোর্ডে পাশের হার ছিল ৮৩.৯২ শতাংশ। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৯ হাজার ২৯০ পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ এবার ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে।
কুমিল্লা বোর্ডে পাশের হার ৬৩.৬০ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৭৯.২৩ শতাংশ। এই বোর্ডে এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৯০২ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১২ হাজার ১০০ জন। অর্থাৎ কুমিল্লা বোর্ডেও পাশের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে।
চট্টগ্রাম বোর্ডে এবার পাশের হার ৭২.০৭ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৮২.৮০ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১১ হাজার ৮৪৩ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১০ হাজার ৮২৪ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বোর্ডে পাশের হার কমেছে। তবে জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও বেড়েছে।
দিনাজপুর বোর্ডে এবার পাশের হার ৬৭.০৩ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৭৮.৪৩ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৬২ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১৮ হাজার ১০৫ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ দিনাজপুর বোর্ডে পাশ ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে।
বরিশাল বোর্ডে পাশের হার ৬৭.০৩ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৮৯.১৩ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ হাজার ১১৪ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৬ হাজার ১৪৫ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ বরিশাল বোর্ডে পাশের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে।
ময়মনসিংহ বোর্ডে এবার পাশের হার ৫৮.২২ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৮৪.৯৭ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৬৭৮ জন। গতবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১৩ হাজার ১৭৫ জন জন। অর্থাৎ ময়মনসিংহ বোর্ডে পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে।
যশোর বোর্ডে এবার পাশের হার ৭৩.৬৯ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৯২.৩৩ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪১০ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২০ হাজার ৭৬২ জন। অর্থাৎ যশোর বোর্ডেও পাশের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে।
রাজশাহী বোর্ডে এবার পাশের হার ৭৭.৬৩ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৮৯.২৫ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ২২ হাজার ৩২৭ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২৮ হাজার ৭৪ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ রাজশাহী বোর্ডে পাশের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে।
সিলেট বোর্ডে এবার পাশের হার ৬৮.৫৭ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৭৩.০৪ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ হাজার ৬১৪ জন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫ হাজার ৪৭১ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ সিলেট বোর্ডে পাসের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা উভয়ই কমেছে।
সব বোর্ডেই গণিতে ফল বিপর্যয়
এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হয়েছে, যা বিগত ১৫ বছরে সর্বনিম্ন। সব বোর্ডেই গণিতে খারাপ করার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাশের হারে। ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজিতেও খারাপ করেছে, তবে গণিতের মতো নয়। দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গণিতে ফেল করেছে।
অপরদিকে ইংরেজিতে ফেল করেছে ১৩ শতাংশ। দুই বিষয়েই ফেলের হার গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া মানবিক বিভাগে ৪৬ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে এবার সার্বিক ফলে। ফলাফল পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলা পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া বা পাশের হার বাড়ানো থেকে বেরিয়ে এসছে অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষার্থীদের অপ্রাসঙ্গিক ও ভুল উত্তরে নম্বর না দেওয়া এবং যথাযথ মূল্যায়নের নির্দেশনা ছিল বোর্ড থেকে। এতে ফলাফলে প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় দশক ধরে খাতা মূল্যায়নে উদারনীতির কারণে দেশে পাশের হার এবং জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে খাতা মূল্যায়নে উদার হওয়ার চর্চা ব্যাপকতা পায়। পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, খাতায় কিছু লেখা থাকলেই যেন নম্বর দেওয়া হয়। এতে পাশের হার ও জিপিএ-৫-এর হার কমে। শিক্ষার সার্বিক মান নিয়ে দেশবিদেশে প্রশ্ন ওঠে।
এ বিষয়ে বুধবার শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়েছে। ১৬ বছরে যে সরকার ছিল, তাদের আমলে সরকারের সাফল্য দেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল প্রকাশ করা হতো। এমনকি সে ফল প্রকাশ নিয়ে একধরনের ফটোসেশনের আয়োজন ছিল সরকারপ্রধানের। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এটাকে বাহুল্য মনে করছে। এটা থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার প্রকৃত মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রেজাল্ট প্রকাশের কারণে অতীতে ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ায় তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ানোর পাশাপাশি জিপিএ-৫-এর সংখ্যাও বেশি পরিমাণে দেখানো হয়েছে। আমরা এবার জিপিএ-৫ নয়, প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন দেখতে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার রেজাল্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা তাদের সেই মেধার যথাযথ মূল্যায়ন দেখতে পাবে। আগামী দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
ফল বিশ্লেষণে পাশের হার কমে যাওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর একটি হচ্ছে, মানবিক বিভাগে পাশের হার মাত্র ৫৪ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের পাশের হার মাত্র ৬৬ শতাংশ। এ দুই বিভাগের ফল সার্বিক পাশের হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এবার মানবিকে প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।
এবার পাশের হার কমে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক খারাপ ফল। এবার সর্বমোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাশ করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ ছাত্রছাত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের সর্বনিম্ন পাশের হার বরিশাল বোর্ডে, যা মাত্র ৫৬ শতাংশ। এর পরে রয়েছে ময়মনসিংহ বোর্ড, যেখানে পাশের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই গ্রামের এবং সুবিধাবঞ্চিত অভিভাবকের সন্তান।
এবার ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি
এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। গতবারের চেয়ে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৩টি বেড়েছে। গতবার শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান ছিল ৫১টি।
এবার সারা দেশে ৩০ হাজার ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। এবার ফলাফল সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এবার ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন, যা গতবার ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।
এবারও মেয়েরা এগিয়ে
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফলের সব সূচকে এবারও মেয়েরা এগিয়ে। দেশের সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রী বেশি পাশ করেছে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ ছাত্রী বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে।
এবার পাশের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ এবং জিপিএ-৫ এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। তার মধ্যে ছাত্রীদের পাশের হার ৭১.০৩ শতাংশ ও ছাত্রদের পাশের হার ৬৫.৮৮ শতাংশ। সেই হিসাবে এবারও পাশের হারে এগিয়ে মেয়েরা। এ নিয়ে টানা ১০ বছর এসএসসিতে পাশের হারে এগিয়ে মেয়েরা।
বিগত ১১ বছরের এসএসসি ও সমমানের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবশেষ ২০১৫ সালে ছাত্রীদের চেয়ে পাশের হারে এগিয়ে ছিল ছাত্ররা। সে বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাশের হার ছিল ৮৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। তার মধ্যে ছাত্রদের পাশের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাশের হার ছিল ৮৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরপর থেকে প্রতিবছর পাশের হারে এগিয়ে ছাত্রীরা। গত বছর পাশের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।
রাজধানীর সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে বরাবরের মতো সাফল্য ধরে রেখেছে ঢাকার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতেও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে এরা।
ভিকারুননিসা নূন : এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাশের হার ৯৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৩২৬ জন। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২ হাজার ১২০ জন। ফেল করেছে ৫৫ জন। এতে সুনামের ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম জানান, এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২ হাজার ১২০ জন, এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ২ হাজার ১১৬ জন। পাশ করেছে ২ হাজার ৬১ জন শিক্ষার্থী, অকৃতকার্য হয়েছে ৫৫ জন। বিজ্ঞান বিভাগে পাশ করেছে ১ হাজার ৮৩৮ জন, ফেল করেছে ৩৭ জন। মানবিক বিভাগে পাশ করছে ৪১ জন, ফেল করেছে ৮ জন। ব্যবসায় শিক্ষায় পাশ করেছে ১৮২ জন, ফেল করেছে ১০ জন। বৃহস্পতিবার দুপরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাস পরীক্ষা চলছে। এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির হলরুমে ফল প্রকাশের আয়োজন করে। অধ্যক্ষসহ শিক্ষকবৃন্দ দুপুর সোয়া ২টায় ফলাফল প্রকাশ করেন। এ সময় পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষকদের জড়িয়ে ধরে আনন্দে কান্না শুরু করেন। জুনিয়র শিক্ষার্থীরা ড্রাম-বাজনা বাজিয়ে আনন্দ করেন।
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ : ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ আবারও প্রমাণ করল তাদের সাফল্যের ধারা। এবারের ফলাফলে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অংশগ্রহণকারী ৮২৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৩৩ জনই পেয়েছে জিপিএ-৫, যা শতকরা হিসাবে ৮৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কলেজটির বিজ্ঞান বিভাগে অংশগ্রহণ করে ৭৭৫ জন শিক্ষার্থী, যার মধ্যে ৭১১ জন জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। এখানে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার ৯১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৫২ জনের মধ্যে ২২ জন পেয়েছে জিপিএ-৫; এ বিভাগে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে পাশের হার দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্ছ্বসিত। সে জানায়, আমাদের কলেজে পড়াশোনার পরিবেশ খুব ভালো। নিয়মিত পরীক্ষা, শিক্ষকদের আন্তরিকতা এবং নিজেদের পরিশ্রমই এই সফলতার পেছনে কাজ করেছে। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুনীর আহমেদ বলেন, এই ফলাফল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং কলেজ প্রশাসনের সম্মিলিত পরিশ্রমের ফসল। আমরা শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি না, ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতা, মননশীলতা ও আÍবিশ্বাস তৈরির দিকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমরা গর্বিত আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে।
উত্তরা মাইলস্টোন কলেজ : এ বছর মাইলস্টোন কলেজ থেকে বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সনে মোট ১৮৬৬ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং পাশ করে ১৮১৪ জন। পাশের হার ৯৭ দশমিক ২১ শতাংশ। পাশ করাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৬৩ জন শিক্ষার্থী। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১৫৮৬ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ১৫৫২ জন। পাশের হার ৯৮ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ অর্জন করে ৬৫৫ জন। অন্যদিকে, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ২২৮ জন শিক্ষার্থী এবং পাশ করে ২১০ জন। কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, এটি একটি গৌরবময় অর্জন যা সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে সম্ভব হয়েছে।
উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাশের হার শতভাগ। ফল প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা স্কুলের ভেতর ও বাইরের রাস্তায় আনন্দ ভাগাভাগি করছেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন। কেউ কেউ এ মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে তুলছেন সেলফি, কেউ একে অপরকে জড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। অনেক অভিভাবকও উপস্থিত ছিলেন। স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাহিয়া তাহসিন বলেন, ‘মনে একটু ভয় ছিল সরকার পরিবর্তনের কারণে ফলাফলে কোনো সমস্যা হবে কিনা। তবে প্রত্যাশিত রেজাল্ট, জিপিএ-৫ পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।’ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আশরাফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের স্কুলে মোট ২৭৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। শতভাগ পাশ করেছে। ১৭৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। ৯০ জন পেয়েছে জিপিএ-৪ এবং ৭ জন জিপিএ-৩। দ্বিতীয় বারের মতো এবারও আমরা শতভাগ পাশের ধারা ধরে রাখতে পেরেছি।’
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ : এ বছর মনিপুর স্কুলে মোট ৪১৪৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৪১৩৭ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে ৩৭৯৬ জন শিক্ষার্থী কৃতকার্য ও ৩৪১ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। পাশের হার শতকরা ৯১.৭৬ । জিপিএফাইভপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩৩৮ জন।
সেন্ট জোসেফ স্কুল : রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেন্ট জোসেফ স্কুলে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা এসেছে। এ প্রতিষ্ঠানটিতে ১৬৪ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবাই পাশ করেছে। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৬২ জন ও ব্যবসা বিভাগ থেকে ২ জনসহ মোট ১৬৪ জন শিক্ষার্থী সফলভাবে পাশ করেছে। এদের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ইংরেজি ভার্সন থেকে ৫৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে এবং বিজ্ঞান বিভাগের বাংলা ভার্সন থেকে ৯৭ জনসহ মোট ১৫০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্কুলের এসএসসির ফলাফল : প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঈর্ষণীয় ফলাফল করেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলে মোট ২৫৬ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ২৫৩ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৯৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এছাড়া মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫৬ জন। লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত অপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গার্লস স্কুলে ২৭৬ জন পরীক্ষা দিয়েছে। এর মধ্যে ২৬৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছে, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৯৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এছাড়া জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯০ জন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ২৪৬ জন পরীক্ষা দিয়ে ২৪১ জন উত্তীর্ণ হয়েছে, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৯৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৮ জন। ঢাকা গভ. মুসলিম হাই স্কুলে ১৫৮ জন পরীক্ষা দিয়ে ১৩৭ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৯ জন। বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৪২ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ২২৩ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭১ জন।