নিলুফার ইয়াসমিন, আমার নীলা খালাম্মা

■ তানিম হায়াত খান ■ 

আম্মা ফওজিয়া ইয়াসমিনরা বিখ্যাত ইয়াসমিন বোন I সবার বড় ফরিদা ইয়াসমিন, তারপর আম্মা ফওজিয়া ইয়াসমিন, তারপর ড. নাজমা ইয়াসমিন, চার নাম্বারে নিলুফার ইয়াসমিন, তারপর সবার ছোট সাবিনা ইয়াসমিন I আমি বলি আমার আম্মার পরে আমার আরেক মা আমার এই নীলা খালাম্মা! ওনার গান শুনলে যেরকম একটা শান্তি শান্তি লাগলে, মানুষটাও ঠিক সেরকমই অসম্ভব ঠান্ডা! কোনদিন গলা উঠিয়ে একটা কথাও বলতে শুনিনি নীলা খালাম্মাকে I ছোট বেলা থেকেই দেখতাম বছরে কয়েকটা দিন নিয়মিত আম্মারা পাঁচ বোন মিলিত হতেন গল্প করবার জন্য I আমি আম্মার সাথে সবসময় যেতাম সেই সব আড্ডায় I সব বোনদের গল্পের মাঝে মাথা নিচু করে চুপ করে গল্প শোনা মানুষটা ছিলেন নীলা খালাম্মা।

নীলা খালাম্মার সাথে আমার দারুন যোগাযোগ বাড়ে যখন উনি ঢাকা ভার্সিটির সংগীত ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেন I আমিও তখন বিবিএ ম্যানেজমেন্ট পড়ছি ঢাকা ভার্সিটিতে। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সালের গল্প। ক্লাসের মাঝখানে মাঝে মাঝেই গ্যাপ থাকতো আমাদের I আমি সেই ক্লাসের গ্যাপে চলে যেতাম সংগীত ডিপার্টমেন্টেI কেমন কেমন করে যেন নীলা খালাম্মারও তখন ক্লাস অফ থাকতো I ব্যস টিচার্স রুমে বসে দুনিয়ার গল্প, সাথে চা সিঙ্গাড়া!

তারপর থেকে – সেই ২০০৩ থেকে আমি এখন পর্যন্ত নীলা খালাম্মার কোনো গান পুরো শুনতে পারিনাI শুধু আমি না। আম্মা, ছোট খালাম্মা আমরা কেউই নীলা খালাম্মার গান শুনতে পারিনা। এতো বছর পরেও ওনার গান শুনলেই এখনো কান্না চলে আসে! নিঝুৃম রাতের এক ক্ষনে মাঝে মাঝেই নীলা খালাম্মার কথা মনে করে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলি এখনওI বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আমার সুরে নীলা খালাম্মা সব রাগ প্রধান কঠিন কঠিন গান করতেন! আমিও হয়তো তখন ওনার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতাম, ”এতো সুখ সইবো কেমন করে …..”

নীলা খালাম্মার যে ওয়ার্ক প্রোফাইল ছিল, সেটা আমার আব্বা সংগীত গবেষক মোবারক হোসেন খান লিখে দেয়I সেটা নিয়ে কাজ করবার সময় নীলা খালাম্মা তখন নিয়মিত আমাদের বাসায় আসতেন, আব্বার সাথে সাথে বসে সব ঠিকঠাক করতেন I এরকমই একদিন আমি বাসার গলিতে ঢুকবো I দেখি, নীলা খালাম্মা আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বেল দিচ্ছেন I তখন প্রায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা! আমি অন্ধকারে পা টিপে টিপে গিয়ে পেছন থেকে গিয়ে হাউ করে চিৎকার করে নীলা খালাম্মাকে দারুন ভয় দেখালাম! সেকেন্ড পরেই দুইজন হাসতে হাসতে শেষ! হৈ চৈ শুনে আম্মা দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন ! নীলা খালাম্মার কপট রাগ, ‘মেজো আপা, দ্যাখ্, আমাকে অন্ধকারে ভয় দেখালো!” আম্মা বললেন , ‘আজকে ওর থার্ড সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে, এখন পর্যন্ত বেষ্ট রেজাল্ট এইটা ওর। এই আনন্দে, তোর সাথে মজা করলো মনে হয় I ”

১৯৯১ সালে আমার এসএসসির রেজাল্ট কি হবে সেটা নিয়ে একটু সংশয় ছিল নীলা খালাম্মার I বড় ভাইবোনদের মতন পড়াশোনায় অতটা মনোযোগী আমি ছিলাম না। দুরন্তপনাই ছিল আমার কাজ! তো রেজাল্ট বের হলো। আমি ষ্টার পেলাম চারটা লেটার সহ I পরেরদিন নীলা খালাম্মার ফোন বাসাতে, ‘যাক বাবা, কি যে টেনশন করছিলামI তুই ষ্টার পাবি আশাই করতে পারছিলাম নাI যা ফাঁকিবাজ পড়াশুনায় তুই!”

১৯৯০ সালে আমার নানা মারা যানI বকশীবাজারে আম্মাদের চাচার বাসাতে (আমাদের বড় নানা) সবাই এক হয়েছিলেন তখনI আমি কোন এক ফাঁকে ওই বাসার ছাদে উঠতে গিয়ে দেখি চিলেকোঠার দরজার সামনে একলা সিঁড়িতে বসে নীলা খালাম্মা কাঁদছেন! বাবার জন্য! কিন্তু কাউকে জানতে দিবেন না, তাই একলা চুপ করে চলে গেছিলেন চিলেকোঠায়!

এবার অন্য একটা দারুন গল্প। ২০০১ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখ আমি বিয়ে করি I আমার বিয়ের সাথে নীলা খালাম্মার স্মৃতি সারাজীবন থেকে যাবে! কারণ আমার হানিমুনের পুরো স্পনসর ছিলেন নীলা খালাম্মা! নীলা খালাম্মা জানতেন আমরা বৌভাতের একদিন পরেই (৮ অক্টোবর, ২০০১) দার্জিলিং চলে যাবো! তাই নীলা খালাম্মা আমার জন্য কোনো গিফট না কিনে আম্মাকে একটা বড় পরিমানের ক্যাশ টাকা দিয়েছিলেন যেন আমি হানিমুন করতে পারি দারুন করে! আমাদের দার্জিলিং যাওয়া আসা, দার্জিলিঙের হোটেল ভাড়া থেকে শুরু করে ওখানকার সাইট সিইং করে কলকাতায় হোটেলে থাকা খাওয়ার সমস্ত খরচ কাভার করেছিল নীলা খালাম্মার সেই গিফট! স্মরণীয় I

২০০৩ সালে যে রাতে ক্যান্সারে নীলা খালাম্মার অকাল প্রয়াণ হয়, তার পরদিন আমাদের সকালটা দিশেহারা হয়ে যায় লাউড স্পিকারে চারিদিক থেকে নীলা খালাম্মার গান বাজানোর কারণে! আসেপাশের সব বাসা থেকে সব টিভি চ্যানেল থেকে শুধু নীলা খালাম্মার গান! আম্মা সহ্য করতে পারছিলেন না একদম! আমাকে বললেন, ‘’রাজিত সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছি, নীলার গান শুনলে খালি কান্না পাচ্ছে !’’

চারিদিক থেকে ভেসে আসছিলো, ‘এতো সুখ সইবো ……’

তারপর থেকে – সেই ২০০৩ থেকে আমি এখন পর্যন্ত নীলা খালাম্মার কোনো গান পুরো শুনতে পারিনাI শুধু আমি না। আম্মা, ছোট খালাম্মা আমরা কেউই নীলা খালাম্মার গান শুনতে পারিনা। এতো বছর পরেও ওনার গান শুনলেই এখনো কান্না চলে আসে! নিঝুৃম রাতের এক ক্ষনে মাঝে মাঝেই নীলা খালাম্মার কথা মনে করে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলি এখনওI বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আমার সুরে নীলা খালাম্মা সব রাগ প্রধান কঠিন কঠিন গান করতেন! আমিও হয়তো তখন ওনার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতাম, ”এতো সুখ সইবো কেমন করে …..”

কিন্তু না, শুধু কান্নাই তো লেখা আছে ভাগ্যে আমার …..

‘নিলুফার ইয়াসমিন, আমার নীলা খালাম্মা’

১৫ জুলাই ২০২৫, সিডনী অস্ট্রেলিয়া থেকে

লেখক: শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের ভাগ্নে

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *