■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাস্তবায়নের হার ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। করোনার সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপি ৮০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়ন হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
বুধবার (২৩ জুলাই) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
আইএমইডির সচিব মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘টাকার কোনো সমস্যা ছিলো না। যখন যে টাকা চেয়েছে তা পেয়েছে। সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্পের ডিজাইন ঠিক না থাকা, ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) না থাকায় বিভিন্ন প্রকল্পে জটিলতা দেখা দেয়। অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়। এসব কারণে গতবারে এডিপি বাস্তবায়নের গতি কমেছে। ৪০৩টি প্রকল্প সময় মতো বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের হারও খুব কম হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন কারণে অগ্রগতি কম হয়েছে। এটা সর্বকালের মধ্যে কম অগ্রগতি কি না, তথ্য না দেখে বলা যাবে না।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথম প্রান্তিকে দেশে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে সবকিছু সমস্যায় ছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার এডিপি সংশোধন করে অর্থ কমিয়েছে। খরচ সাশ্রয়ী করার চেষ্টা করা হয়েছে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো সেবা খাতে কম বাস্তবায়ন হয়েছে। তা বাড়ানো দরকার ছিল। মানব জীবনে সেবা খাতের গুরুত্ব অপরিসীম।’
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরের পর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত সংশোধিত এডিপির ৮০ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়। টাকার অঙ্কে গত অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। সংস্থার নিজস্ব তহবিলের অর্থায়নসহ সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ থেকে খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৫ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
আইএমইডির বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরের আগের অর্থবছরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে বছর ভোটের কারণে কাজে বিঘ্ন ঘটলেও ২ লাখ ৫ হাজার ১১৮ কোটি টাকা খরচ করে ৮০ দশমিক ৬৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করে ৫৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ লাখ ৩ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা খরচ করে এডিপির ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়। করোনার বছরেও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা খরচ করে ৮২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়।
এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮০ শতাংশ, ২০১৮-১৯ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৪ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯০ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯৩ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯১ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৯৩ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯১ শতাংশ ও ২০১১-১২ অর্থবছরেও ৯৩ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। এভাবে প্রতি অর্থবছরে ৮০ শতাংশের বেশি এডিপি বাস্তবায়ন হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগে, মাত্র ১৫ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২২ শতাংশ। এভাবে অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগেও এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। ৪২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় খরচ করেছে ১৩৬ কোটি টাকা, বাস্তবায়নের হার ৩২ শতাংশ। ভূমি মন্ত্রণালয়ও ৪৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে খরচ করে ১৭৪ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন করে ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে খরচ করে ২৮ কোটি টাকা, বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
তবে স্থানীয় সরকার বিভাগে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে বাস্তবায়ন করে সাড়ে ৮৪ শতাংশ। এরপরই বিদ্যুৎ বিভাগ, ২৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে ৯৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। শতভাগ কাজ কোনো মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
বিদায়ী অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। এমন ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। কোভিডের শুরুর বছরে আগের বছরের কম খরচ হয়েছিল। তবে এত ব্যবধান হয়নি। গত অর্থবছরে এডিপির ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপির ২ লাখ ৫ হাজার ১১৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।
২০০৪-০৫ অর্থবছরের পর থেকে গত অর্ধবছর পর্যন্ত সংশোধিত এডিপির ৮০ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা। কিন্তু গত অর্থবছরের মতো এত কম বাস্তবায়ন হয়নি।
গত অর্থবছরের এডিপি বা প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে খারাপ করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ। এ বিভাগের ১৫টি প্রকল্পের অনুকূলে ২ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বছর শেষে এসব প্রকল্পের কর্মকর্তারা মাত্র ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এই বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার মাত্র ১৫ শতাংশ।
সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করা শীর্ষ পাঁচের মাধ্যমে থাকা অন্য চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হলো স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ (বাস্তবায়ন ২১ শতাংশ); নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (৩২ শতাংশ); বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (৩৭ শতাংশ); ভূমি মন্ত্রণালয় (৩৭ শতাংশ)। অন্যদিকে সবচেয়ে ভালো করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এই বিভাগ তাদের বরাদ্দের ৯৮ শতাংশ টাকা খরচ করেছে।