৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন ১৫ সেপ্টেম্বর 

■ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■ 

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর হবে ভোট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এনামুল হক এ তফসিল ঘোষণা করেন।

নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এনামুল হক জানান, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে কমিশন বদ্ধপরিকর। এ সময় তিনি সকল ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা কামনা করেন।

তপশিল অনুযায়ী, আগামী ৩১ জুলাই নির্বাচনের আচরণবিধি প্রকাশ করা হবে। এরপর ৬ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং ৭ ও ১০ থেকে ১২ আগস্ট ভোটার তালিকার ওপর আপত্তি গ্রহণ ও নিষ্পত্তি শেষে ১৪ আগস্ট চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।

মনোনয়নপত্র বিতরণ চলবে ১৭ থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। প্রার্থীরা ২১ এবং ২৪ থেকে ২৫ আগস্ট তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন। দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র ২৭ ও ২৮ আগস্ট বাছাই করে ৩১ আগস্ট প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে। কোনো প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে চাইলে তার জন্য ২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষে ৪ সেপ্টেম্বর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।

আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর (সোমবার) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একযোগে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ভোটগ্রহণ শেষে ওই দিনই গণনা সম্পন্ন করে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

তফসিল ঘোষণা অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এই নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখা, শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুসংহত করা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে। এই লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখেই আজ রাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হলো।’

স্বাগত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন ২০২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশক পর এই বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে আমরা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সূচনার পথে অগ্রসর হচ্ছি। রাকসু নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আইন-শৃঙ্খলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নির্বাচন গ্রহণ থেকে নির্বাচনের ফল প্রকাশ করা পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটবে না, ইনশাআল্লাহ।

তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ‘নির্বাচনে নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে ছাত্র রাজনৈতিক ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। এ ছাড়া শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেই আমরা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছি। নির্বাচন–সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে সাংবাদিকসহ সব অংশীজনের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা পর্যবেক্ষণ করবেন। আমরা আপনাদের পর্যবেক্ষণকে মূল্যায়ন করে নির্বাচন আয়োজন করতে যেকোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।’

এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন রাকসুর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সেতাউর রহমান, নির্বাচন কমিশনার ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিনসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, জনসংযোগ দপ্তর প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার, প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমানসহ বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পর ১৯৬২ সালে রাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর মোট ১৪টি নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ রাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন রাকসু নির্বাচনের দাবি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে শেষ পর্যন্ত পথনকশা অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে আজ বিকেলে নির্বাচনের বিস্তারিত তথ্য জানাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

১৯৫৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইতরাৎ হোসেন জুবেরীর কাছে ছাত্র সংসদের দাবি উত্থাপন করা হলেও ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের হস্তক্ষেপে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ঐ বছরই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথম ভিপি হিসেবে মনিরুজ্জামান মিয়া ও জিএস হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক খান নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার ফলে ১৯৫৮-৬২ সাল পর্যন্ত রাকসুর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে ক্যাম্পাসে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে শিক্ষার্থীরা পুনরায় ছাত্র সংসদ চালু করতে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদর নিকট জোর দাবি জানায়। ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) কার্যক্রমের অনুমতি দেয়।

পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাকসু -এর সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সদস্যরা সরাসরি ভোট দিয়ে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং অন্যান্য পদ নির্বাচন করেন। রাকসু সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও রুহুল কুদ্দুস বাবু এক বছরের জন্য যথাক্রমে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া সামরিক শাসনের জন্য ১৯৭৫-১৯৮০ এবং ১৯৮১-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত ছিল। ১৯৮৯ সাল এর পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে

রাকসু নেতৃবৃন্দের তালিকা

ক্রমিকসালভিপিসংগঠনজিএস
১৯৫৬-১৯৫৭মো. মনিরুজ্জামান মিয়াবাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নমো. আব্দুর রাজ্জাক খান
১৯৫৭-১৯৫৮আবুল কালাম চৌধুরীমো. আব্দুর রাজ্জাক খান
১৯৬২-১৯৬৩শেখ মো. রুস্তম আলীমো. বজলুর করিম
১৯৬৩-১৯৬৪সৈয়দ মাজহারুল হকমো. আব্দুর রউফ
১৯৬৪-১৯৬৫আব্দুর রাজ্জাকবায়েজীদ আহম্মদ
১৯৬৫-১৯৬৬অধ্যাপক আবু সাইয়িদবাংলাদেশ ছাত্রলীগসরদার আমজাদ হোসেন
১৯৬৬-১৯৬৭বায়েজীদ আহম্মদআব্দুস সাত্তার
১৯৬৭-১৯৬৮এ.এফ.এম জামিরুল ইসলামমো. আব্দুর রহমান
১৯৬৮-১৯৬৯মো. আব্দুর রহমানজালাল উদ্দিন সেলিম
১০১৯৬৯-১৯৭০মীর শওকত আলীআব্দুস সামাদ
১১১৯৭২-১৯৭৩মো. হায়দার আলীআহমেদ হোসেন
১২১৯৭৩-১৯৭৪নুরুল ইসলাম ঠান্টুশামসুল হক টুকু
১৩১৯৭৪-১৯৭৫ফজলুর রহমান পটলরফিকুল ইসলাম
১৪১৯৮০-১৯৮১ফজলে হোসেন বাদশাবাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীআবুল কালাম আজাদ
১৫১৯৮৮-১৯৮৯রাগীব আহসান মুন্নাবাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীরুহুল কুদ্দুস বাবু
১৬১৯৮৯-১৯৯০রুহুল কবির রিজভী আহমেদবাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলরুহুল কুদ্দুস বাবু

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *