■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
চলতি বছরের মার্চ শেষে ২৩টি ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড।
গত ডিসেম্বর শেষে ১৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। মূলত গত ডিসেম্বরভিত্তিক ২৮টি ব্যাংকে ডেফারেল সুবিধা দিয়েছে, যার ফলে ঘাটতির পরিমাণ কমেছে। তবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মূলধন ঘাটতির পরিমাণ কমলেও ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতির মুখে পড়ে। ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে।
জনতা ব্যাংকের ঘাটতি মার্চ শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকায়, যেখানে ডিসেম্বর শেষে ছিল ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে বলে এই বিশাল ঘাটতি কমে এসেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ দিকে অগ্রণী ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পেয়েও ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। মার্চ শেষে অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে ডেফারেল সুবিধা পেয়ে ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৭০ কোটি টাকায়।
অন্যদিকে, বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ডেফারেল সুবিধা পেয়েও বেড়ে ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ২ হাজার ৫১১ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে।
ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে পড়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। মার্চ শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল ১৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সাত হাজার ৭৯০ কোটি টাকার ঘাটতিতে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার ঘাটতিতে, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ৯৮১ কোটি টাকায়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৯৮০ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ১ হাজার ৪৯৯ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংক ৫২১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এদের মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া অন্য সব ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংক মার্চ শেষে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ডেফারেল সুবিধা নিয়ে ঘাটতি অনেকটাই কমাতে পেরেছে ব্যাংকটি। ন্যাশনাল ব্যাংকও একইভাবে সুবিধা নিয়ে ঘাটতি কমিয়ে এনেছে—ডিসেম্বরের ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা থেকে মার্চে ৬ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকায়।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পেয়েও তার ঘাটতি ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এবি ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। পদ্মা ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় তার ঘাটতিও বেড়েছে—ডিসেম্বরে ছিল ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, যা মার্চে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৭১ কোটি টাকায়।
যেসব ব্যাংকের আগে মূলধন ঘাটতি ছিল না, সেগুলোর মধ্যেও নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে কয়েকটি ব্যাংক। প্রিমিয়ার ব্যাংক মার্চ শেষে ১ হাজার ১৭১ কোটি, সীমান্ত ব্যাংক ২৬ কোটি এবং ইউসিবি (ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক) ৯৫৪ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। এ ছাড়া সিটিজেন ব্যাংক ৮৬ কোটি টাকার এবং হাবিব ব্যাংক (একমাত্র বিদেশি ব্যাংক, যা ঘাটতির তালিকায়) ৩৬ লাখ টাকার ঘাটতিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তারা মূলধন ঘাটতি পূরণের একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা চাইবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পুরো ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। খেলাপি ঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের জাল ছিন্ন করেই কেবল খাতটি পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা পর্যবেক্ষণ জোরদার করেছে এবং ঘাটতিপূর্ণ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা—এই ব্যাংকগুলো একাধিকবার সময় পেলেও ঘাটতি কাটাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির ঘাটতি, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অভাবেও ব্যাংকগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।