■ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৫ নারীসহ মোট ৪৮ জন লড়বেন এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মোট ২৮ জন লড়বেন।
বৃহস্পতিবার রাতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ডাকসু নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দীন এ কথা জানান।
তিনি বলেন, আজ বৈধ প্রার্থী তালিকা প্রকাশের তারিখ। ডাকসু নির্বাচনে মোট প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছে ৪৬২ জন। ত্রুটিপূর্ণ পাওয়া গেছে ৪৭ মনোনয়নপত্র।
মোট ৫০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল বলে জানান তিনি।
ডাকসু নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ (গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ) এবং অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪ (বামপন্থী তিন সংগঠনের যৌথ প্যানেল)।
এর আগে প্যানেল ঘোষণা করেছিল প্রতিরোধ পর্ষদ (বামপন্থী সাত ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্যানেল), ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট (ইসলামী ছাত্রশিবির), ডিইউ ফার্স্ট (মাহিন সরকার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র প্যানেল), ডাকসু ফর চেঞ্জ, ভোট ফর চেঞ্জ (ছাত্র অধিকার পরিষদ), ছাত্র ফেডারেশন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন এবং সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য (স্বতন্ত্র প্যানেল)।
প্যানেল ছাড়াও অনেকে ডাকসুর বিভিন্ন পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তাদের মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রার্থী হওয়া জুলিয়াস সিজার তালুকদারকে নিয়ে ক্যাম্পাসে আলোচনা আছে। কারণ, তিনি একসময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। বিভিন্ন পক্ষ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দাবি তুললেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার প্রার্থিতা বহাল রেখেছে।
এর আগে, সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় সক্রিয় হয় ডাকসু।
২০১৯ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন নুরুল হক নুর, জিএস ছিলেন গোলাম রাব্বানী এবং এজিএস পদে নির্বাচিত হন সাদ্দাম হোসেন।
১০৪ বছর বয়সী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন পর্যন্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। এর মধ্যে ২৯ বারই হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ৫০ বছরে। স্বাধীন দেশে ৫৩ বছরে মাত্র ৮ বার ভোট দেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে প্রতি বছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু গত সাড়ে তিন দশকে নির্বাচন হয়েছে কেবল একবার।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়। ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ বলা হয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার হল এই ছাত্র সংসদ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা রাখে এই ছাত্র সংসদ। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।
১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের একটি সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ পূর্বোল্লিখিত শিক্ষক সভার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়। ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে সম্পাদক ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, পরের বছর অবনীভূষণ রুদ্র। ১৯২৯-৩০ সালে সম্পাদক নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান।
পরবর্তীতে ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ১৯৯০ পর্যন্ত ৩৬ বার নির্বাচন হয়েছে।
ডাকসুতে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী ছাত্রসংগঠন জয়ী হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে ৯০ পরবর্তী সরকারগুলো এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহ ছিল। উপাচার্য একে আজাদ চৌধুরী ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও নানা মহলের চাপ ও বাধায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন আর হয়নি। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ও সুযোগ না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর বড় নেতাদেরও অনাগ্রহ ছিল। ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থবহ কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার–ঘনিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোয় ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য।
উপাচার্যকে সভাপতি এবং ১৬ জন ছাত্র প্রতিনিধি থেকে ১০ জন কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়, কোষাধাক্ষের দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। ২০১৯ সালে সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, পদাধিকারবলে ডাকসুর সভাপতি উপাচার্যসহ এর নির্বাহী কমিটি হবে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট। ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে ডাকসুর কথা বলা হয়েছে৷ আর ডাকসুর গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ডাকসু নির্বাচন হবে৷ কীভাবে হবে, কাদেরকে নিয়ে হবে, সেগুলো বিস্তারিত বলা আছে গঠনতন্ত্রে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংসদ আছে৷ সেখানেও সরাসরি ভোটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷
৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। ডাকসুর নেতৃবৃন্দের সাহসী ও বলিষ্ঠ উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।