নেপালে বিক্ষোভে মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘিরে বিক্ষোভে সংঘর্ষ ও মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক পদত্যাগ করেছেন। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির বাসভবন বালুওয়াতারে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।

বৈঠকে উপস্থিত এক মন্ত্রী জানিয়েছে, জেন জি বিক্ষোভ চলাকালে সোমবার কাঠমাণ্ডুতে ১৮ জন এবং ইতাহারিতে ২ জন নিহত ও চার শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার পর নৈতিকতার কারণে লেখক পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক মন্ত্রিসভায় নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। তিনি বলেন, ‘এত মানুষের প্রাণহানি অচিন্তনীয়। নৈতিকভাবে আমার আর দায়িত্বে থাকা উচিত নয়।’

এর আগে নেপালি কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গগন থাপা ও বিশ্বপ্রকাশ শর্মা কংগ্রেসের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নৈতিকতার ভিত্তিতে লেখকের পদত্যাগ দাবি করেন।

এদিকে সরকারের দমননীতির তীব্র সমালোচনা করেছে রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি (আরএসপি)। দলটির সাধারণ সম্পাদক কবীন্দ্র বুর্লাকোটি এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার জেন-জেড প্রজন্মের ওপর ‘নৃশংস দমননীতি’ চালিয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ ও অবিলম্বে নতুন জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।

সহিংস বিক্ষোভ শুধু কাঠমান্ডুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। নেপালের বুটওয়াল, ভৈরহাওয়া, ইটাহারিসহ কয়েকটি জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় দামাকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয় আর ইস্ট-ওয়েস্ট হাইওয়ে অবরোধ করে আগুন জ্বালানো হয়।

সম্প্রতি আদালতের একটি আদেশের পর নেপালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধনের জন্য সাত দিনের সময় বেঁধে দেয়। ওই সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধন না করায় ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূলত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ভুয়া খবর ও অনলাইন অপরাধ দমনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ওপর নতুন নিয়মনীতি কার্যকর করা হয়েছে। তবে এর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট সতর্ক করেছে যে এই নিষেধাজ্ঞা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে।

এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর থেকে সচল থাকা সামাজিক মাধ্যমে টিকটকে সাধারণ নেপালিদের ধুঁকতে থাকা জীবনের বিপরীতে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল পণ্যের প্রদর্শন এবং ব্যয়বহুল অবকাশযাপনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানাতে রোববার কয়েক ডজন সাংবাদিক রাজধানীতে সমাবেশ করেন। এ সময় তাঁরা ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ নয়, কণ্ঠ রোধ করা যাবে না’, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের স্বাধীনতা’ এবং ‘গণতন্ত্র হরণ, কর্তৃত্ববাদের প্রত্যাবর্তন’ ইত্যাদি স্লোগান–সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।

সোমবার বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেওয়ার আগে সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনাকারীদের প্রতি অসন্তোস প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। তিনি বলেন, দেশকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা সহ্য করবেন না।

রোববার এক বিবৃতিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু ব্যক্তির কাজ হারানোর চেয়ে দেশের স্বাধীনতা বড়। আইনকে উপেক্ষা, সংবিধান অবমাননা এবং জাতীয় মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অসম্মান কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিয়ে সুনাম ছিল নেপালের। তবে কে পি শর্মা অলির সরকার আমলে এ বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে বলে সমালোচকেরা বলছেন। এর আগে ২০২৩ সালে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে ৯ মাস টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। পরে টিকটক কর্তৃপক্ষ সরকারের নিয়ম মেনে নিবন্ধন নেওয়ার পর তাদের আবার কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হয়।

সহিংসতার পর রাজধানী কাঠমান্ডুর বিভিন্ন এলাকায় কারফিউ জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এ ছাড়া দেশের অন্য প্রধান শহরগুলোতেও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কার্যালয় রাজধানীতে কারফিউর মেয়াদ বাড়িয়েছে। সরকারিভাবে দুর্নীতি ও সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে জেনারেশন জেড বা জেন জেডের বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রথমে বানেশ্বরের কিছু এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছিল। কারণ, বিক্ষোভকারীরা সেখানে একটি নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। তবে নতুন সিদ্ধান্তে কারফিউয়ের পরিধি আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। এখন এটি রাষ্ট্রপতির বাসভবন শীতল নিবাস এলাকা, মহারাজগঞ্জ, ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবন, সিংহ দরবারের চারপাশ, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বলুয়াতার ও এর আশপাশের এলাকা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে কারফিউ বাড়ানো হয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *