তিন মাসে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ৭৩০৭৯ কোটি টাকা

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে গ্রামীণ অঞ্চলে আমানত বেড়েছে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যেখানে শহরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। জুন শেষে ব্যাংক খাতে থাকা মোট আমানতের মধ্যে শহরাঞ্চলের অংশ ১৬ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা (৮৪ দশমিক ১৭ শতাংশ) এবং গ্রামীণ এলাকার অংশ ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা (১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ)।

অন্যদিকে, আমানতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সুদের হারও কিছুটা বেড়েছে। মার্চ শেষে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা জুন শেষে বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, সুদহার বৃদ্ধিই আমানত বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

শুধু আমানত নয়, তিন মাসে ব্যাংক খাতে ঋণও বেড়েছে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১২ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ২৬ শতাংশ।

ঋণ বণ্টনের ক্ষেত্রেও শহর ও গ্রামের মধ্যে স্পষ্ট বৈষম্য রয়েছে। জুন শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বা ১৬ লাখ ৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা গেছে শহরাঞ্চলে। অন্যদিকে, গ্রামীণ এলাকায় গেছে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। আর জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

বিশ্লেষকদের মতে, গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সেবা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেশি হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র ও প্রণোদনা প্রকল্পও গ্রামীণ আমানত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

অমানত বৃদ্ধির পেছনে সুদের হারও বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশে। সুদের এই সামান্য বৃদ্ধি আমানতকারীদের ব্যাংকের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতে আস্থা কিছুটা ফিরতে শুরু করলেও মূলত সুদের হারের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে আমানত বাড়াতে উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে নগদ অর্থ ধরে রাখার বদলে ব্যাংকে জমা করলে অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় অনেকে ব্যাংকে অর্থ জমাতে আগ্রহী হচ্ছেন।

কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি

অর্থনৈতিক মন্দা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্থরগতির মধ্যেও তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৪টি। গত মার্চে ব্যাংকে কোটি টাকার ওপরে আমানতের স্থিতি রয়েছে এমন হিসাব ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২টি। গত জুন পর্যন্ত এ ধরনের হিসাব সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টিতে।

আলোচ্য সময়ে ওইসব হিসাবে আমানতের জমা অর্থের পরিমাণও বেড়েছে। ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। পাশাপাশি ব্যাংক খাতেও সার্বিকভাবে আমানতের প্রবাহ বেড়েছে। তবে এবার ব্যতিক্রম হচ্ছে, গ্রামে ব্যাংকের শাখাগুলোতে আমানত শহরের তুলনায় বেশি বেড়েছে। আগে শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত কম বাড়ত।

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় থেকে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার প্রবণতা বেড়ে যায়। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে টাকা তোলার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। তবে গত ডিসেম্বর থেকে ব্যাংকে টাকা ফিরতে শুরু করেছে। তবে আগের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে মার্চেও আমানত বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং গ্রামে বেড়েছে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত বছরের একই প্রান্তিকে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমায় গড়ে ব্যাংকগুলোতে এখনো তারল্য সংকট বিদ্যমান রয়েছে।

এখন মন্দার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ না হওয়ায় অনেকে টাকা এখন ব্যাংকে রাখছেন। এছাড়া আমানতের সুদের হার চড়া থাকায় ব্যাংকে বিনিয়োগকে লাভজনক মনে করছেন অনেকে। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ১ কোটি টাকার বেশি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা গত মার্চে ছিল ৯৫ হাজার ৯৩২টি। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৬০টিতে। ৫ কোটি টাকার বেশি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা রয়েছে এমন আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা গত মার্চে ছিল ১২ হাজার ৯৯১টি। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫৫৮টিতে। ১০ কোটি টাকার বেশি থেকে ১৫ কোটি টাকা আমানত রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা গত মার্চে ছিল ৪ হাজার ৪৪১টি। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৮৪টি। ১৫ কোটি টাকার বেশি থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর হিসাব গত মার্চে ছিল ২ হাজার ৩৩টি। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১২২টিতে।

একই সময়ের ব্যবধানে ২০ কোটি টাকার বেশি থেকে ২৫ কোটি টাকার জমা রয়েছে এমন হিসাব সংখ্যা ১ হাজার ৩৫৪টি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪০১টিতে দাঁড়িয়েছে। ২৫ কোটি টাকার বেশি থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা রয়েছে এমন হিসাবধারীর সংখ্যা একই সময়ে ৯৬০টি থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৯৬টি। ৩০ কোটি টাকার বেশি থেকে ৩৫ কোটি টাকা জমা রয়েছে এমন হিসাবধারীর সংখ্যা আলোচ্য সময়ে ৬টি কমেছে। গত মার্চে এ ধরনের হিসাব ছিল ৮৮৩টি। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭৭টিতে। একটি ছাড়া বাকি সব ক্যাটাগরিতেই আমানতকারী হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে। এ ক্যাটাগরির হিসাবে জমা টাকার স্থিতিও কিছুটা কমেছে।

৩৫ কোটি টাকার বেশি থেকে ৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা হিসাবের সংখ্যা আলোচ্য সময়ে ৩৭৭টি থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২০টি। ৪০ কোটি টাকার বেশি থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা হিসাবধারীর সংখ্যা ৭৬৯টি থেকে বেড়ে ৮১৭টি হয়েছে। ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন হিসাব সংখ্যা গত মার্চে ছিল ১ হাজার ৯২২টি। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১টিতে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *