■ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হয়েছেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু। আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) মাজহারুল ইসলামসহ বেশির ভাগ শীর্ষ পদে জয় পেয়েছে শিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’।
শনিবার বিকেলে প্রায় ৫০ ঘণ্টা ধরে ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষে এই ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান। তিনি জানান, ভিপি পদে আব্দুর রশিদ জিতু পেয়েছেন ৩ হাজার ৩২৪ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের আরিফ উল্লাহ পেয়েছেন ২ হাজার ৩৭৯ ভোট।
জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন শিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের মাজহারুল ইসলাম, তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৩০ ভোট। এই পদে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ–সমর্থিত ঐক্য ফোরামের আবু তৌহিদ সিয়াম পেয়েছেন ১ হাজার ২৩৮ ভোট।
শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ২ হাজার ৩৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ফেরদৌস আল হাসান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ভোট পেয়েছেন তিন হাজার ৪০২।
ভোট বর্জনকারী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসান পেয়েছেন ৬৪৮ ভোট এবং জিএস প্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী পেয়েছেন ৯৪১ ভোট।
এছাড়া, নির্বাচিত হয়েছেন- শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে ফার্মেসি বিভাগের আবু উবায়দা উসামা (২,৪২৮), পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সম্পাদক পদে গণিত বিভাগের সাফায়েত মীর (২,৮১১), সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ইংরেজি বিভাগের জাহিদুল ইসলাম বাপ্পি (১,৯০৭), সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে শেখ জিসান আহমেদ (২,০১৮) ও সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের রায়হান উদ্দিন (১,৯৮৬), নাট্য সম্পাদক পদে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের রুহুল ইসলাম (১,৯২৯), ক্রীড়া সম্পাদক পদে বাংলা বিভাগের মাহমুদুল হাসান কিরণ (৫,৭৭৮), সহ-ক্রীড়া (ছাত্র) সম্পাদক পদে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের মাহাদী হাসান (২,১০৫) এবং সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (ছাত্রী) গণিত বিভাগের ফারহানা লুবনা (১,৯৭৬)। আইটি ও গ্রন্থাগার পদে ফার্মেসি বিভাগের রাশেদুল ইমন লিখন; সমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন পদে আহসান লাবিব (১,৬৯০), সহ-সমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন পদে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের (ছাত্র) তৌহিদ হাসান (২,৪৪২) এবং সহ-সমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন (ছাত্রী) পদে ফার্মেসি বিভাগের নিগার সুলতানা (২,১৬৬) জয়ী হয়েছেন।
স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের হুসনী মোবারক (২,৬৫৩) এবং পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক পদে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের তানভীর রহমান (২,৫৫৯)।
এছাড়া, কার্যকরী সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন ফাবলিহা জাহান নাজিয়া (২,৪৭৫), নাবিলা বিনতে হারুন (২,৭৫০), নুসরাত জাহান ইমা (৩,০১৪), হাফেজ তরিকুল ইসলাম (১,৭৪৬), আবু তালহা (১,৮৫৪) ও মোহাম্মদ আলী চিশতী (২,৪১৪)।
৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩, এরমধ্যে ছাত্র ৬ হাজার ১৫ এবং ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮। ভোট পড়েছে ৮ হাজার ৩টি, যা মোট ভোটের প্রায় ৬৮ শতাংশ। জাকসুর ২৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১৭৭ জন। এরমধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৯ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৮ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে ৬ জন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ১০ জন লড়েন। এছাড়া, হল সংসদে লড়েন ৪৪৫ জন।
নির্বাচন সামনে রেখে মোট আটটি প্যানেল ঘোষণা করা হয়। তবে এর বাইরেও অনেক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
আট প্যানেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্যানেলগুলো হলো— ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ এবং ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’।
ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ হলেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে—জামায়াত-সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন সরবরাহ, অনুমতি থাকা সত্ত্বেও পোলিং এজেন্টদের প্রবেশে বাধা, ডোপ টেস্টের ফলাফল প্রকাশ না করা এবং নির্বাচন ‘ম্যানিপুলেট’ করার চেষ্টা।
ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। পরে ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) ‘সম্প্রীতির ঐক্য’, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ ও ছাত্র ফ্রন্টের আংশিক প্যানেলও একই পথে হাঁটে। কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
এ ছাড়া নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক। তারা হলেন, গণিত বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম ও অধ্যাপক শামিমা সুলতানা। শুক্রবার রাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার।
এদিকে ভোট গণনা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মূল জটিলতা তৈরি হয় ভোট গণনার পদ্ধতি বদলানোর কারণে। অভিযোগ ওঠে, জামায়াত-সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে কেনা ওএমআর মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত মেশিনের বদলে হাতে ব্যালট গোনার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এতে ভোট গণনায় ব্যাপক দেরি হয়।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সিনেট ভবনে ভোট গণনা শুরু হয়। প্রায় ২৪ হাজার ব্যালট হাতে গুনতে গিয়ে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত শনিবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়।
শিবিরের প্যানেলের বাইরে জয় পেলেন যারা
ভিপিসহ চারটি পদে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র ও অন্য প্যানেলের প্রার্থীরা। তাদের মধ্যে ভিপি পদে আব্দুর রশিদ জিতু (স্বতন্ত্র), সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মহিবুল্লাহ শেখ জিসান (স্বতন্ত্র), সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক পদে আহসাব লাবিব (গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-বাগছাস) এবং ক্রীড়া সম্পাদক পদে মাহমুদুল হাসান কিরন (স্বতন্ত্র) বিজয়ী হয়েছেন।
শিক্ষার্থী জোট থেকে বিজয়ীরা হলেন জিএস মো. মাজহারুল ইসলাম, এজিএস (ছাত্র) ফেরদৌস আল হাসান ও এজিএস (ছাত্রী) আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা, শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক আবু ওবায়দা ওসামা, পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মো. শাফায়েত মীর, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. জাহিদুল ইসলাম, সহ সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. রায়হান উদ্দীন, নাট্য সম্পাদক মো রুহুল ইসলাম, সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (নারী) ফারহানা আক্তার লুবনা, সহ-ক্রীড়া সম্পাদক (পুরুষ) মো. মাহাদী হাসান, তথ্য-প্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক মো. রাশেদুল ইসলাম লিখন, সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (নারী) নিগার সুলতানা, সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (পুরুষ) মো. তৌহিদ হাসান, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সম্পাদক হুসনী মোবারক এবং পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক মো. তানভীর রহমান।
এছাড়া, কার্যকরী সদস্যরা হলেন মো. তরিকুল ইসলাম, মো. আবু তালহা, মো. মহসিন, নাবিলা বিনতে হারুণ, ফাবলিহা জাহান ও নুসরাত জাহান ইমা। এ পদে নির্বাচিত সবাই শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রার্থী ছিলেন।
জাকসুর কার্যকরী সদস্য নির্বাচিত হলেন যাঁরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে কার্যকরী সদস্য পদে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে কার্যকরী সদস্য পদে পুরুষ তিনজন ও নারী তিনজন নির্বাচিত হয়েছেন।
কার্যকরী সদস্য (পুরুষ) পদে নির্বাচিত হয়েছেন— মোহাম্মদ আলী চিশতি, মো. আবু তালহা (শিবির প্যানেল) ও মো. তরিকুল ইসলাম (শিবির প্যানেল)।
কার্যকরী সদস্য (নারী) পদে নির্বাচিত হয়েছেন— নুসরাত জাহান ইমা, নাবিলা বিনতে হারুন (শিবির প্যানেল) ও ফাবলিহা জাহান নাজিয়া।
জাহানারা ইমাম হলে সমান ভোট পেয়ে এজিএস হলেন দুজন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদ নির্বাচনে এজিএস পদে ১১৩ ভোটে টাই হয়েছে। এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা লামিয়া জান্নাত ও সাদিয়া খাতুন উভয়েই ১১৩টি করে ভোট পেয়েছেন।
এতে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে লামিয়া জান্নাত প্রথম ছয় মাস দায়িত্ব পালন করবেন। এর পরের ছয় মাস দায়িত্ব পালন করবেন সাদিয়া খাতুন।