■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
ঢাকার আকাশে ৯ সেকেন্ড ধরে স্থায়ী টার্বুলেন্সের তীব্র ঝাঁকুনিতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজের কেবিন ক্রুর। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ালেও তারা নিরাপদে ছিলেন।
শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার কিছু সময় পর বিমানের বিজি ১২৮ ফ্লাইটে এই ঘটনা ঘটে। বোয়িং ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজটি দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় ফিরছিল।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপদ অবতরণের পর দুর্ঘটনার শিকার কেবিন ক্রু শাবামা আজমী মিথিলাকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়া হয়।
জানা গেছে, বিমানটি প্রায় ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় থাকাকালে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে সময় ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস মিথিলা কেবিনে তাঁর রুটিন দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ প্রবল টার্বুলেন্স শুরু হয়, যা প্রায় ছয় সেকেন্ড স্থায়ী ছিল। সে সময় যাত্রীদের জন্য সিটবেল্টের সতর্কীকরণ সংকেত তখনো চালু হয়নি।
হঠাৎ ধাক্কায় শাবামা আজমী মিথিলা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত ভেঙে যায়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায়ও তিনি ফ্লাইটে ছিলেন।
অভিযোগ উঠেছে, দুর্ঘটনার পর বিমানবন্দর মেডিকেল সেন্টার থেকে কোনো চিকিৎসক ঘটনাস্থলে আসেননি। এমনকি জরুরি ভিত্তিতে অ্যাম্বুলেন্সও সরবরাহ করা হয়নি। বাধ্য হয়ে একজন নারী সহকর্মীর সহায়তায় মিথিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এক্সরে পরীক্ষায় দেখা গেছে, তার বাম হাতের কনুইয়ের ওপরের (বাহু) হাড় ভেঙে অনেকটা আলাদা হয়ে গেছে।
এর আগে শুক্রবার সকালে বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের বিজি-১২৮ ফ্লাইটটি দুবাই থেকে চট্টগ্রামে অবতরণ করে। সেখানে যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর ঢাকার যাত্রী ও অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীদের নিয়ে ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কেবিন ক্রুরা যাত্রীদের প্রাথমিক সার্ভিস করার মধ্যেই উড়োজাহাজটি ততক্ষণে ঢাকার আকাশে চলে আসে। তখনই উড়োজাহাজে তীব্র ঝাঁকুনি শুরু হয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই যাত্রীরা আতঙ্কে কান্না-চিৎকার শুরু করেন। টার্বুলেন্সের মধ্যে পড়ে অন্তত ৯ সেকেন্ড ধরে উড়োজাহাজটি এলোমেলোভাবে ঝাঁকুনি দিতে থাকে।
ওই ফ্লাইটটির পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন ইন্তেখাব হোসাইন। তিনি বিমানের ডেপুটি চিফ অব ফ্লাইট সেফটি পদেও রয়েছেন। ফ্লাইটে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ফ্লাইট পার্সার রনি। ফ্লাইট স্টুয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলেন শাবামা আজমী মিথিলা।
মিথিলার এক সহকর্মী জানান, মিথিলা তখন যাত্রী সার্ভিস শেষ করে উড়োজাহাজের পেছনের দিকে দাঁড়িয়েছিলেন, অপর সহকর্মী নিজ আসনে বসা ছিলেন। তখনই টার্বুলেন্সের শিকার হয় সেটি। এতে মিথিলা গ্যালির ফ্লোরে পড়ে যান।
মিথিলার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, চিকিৎসকরা মিথিলার স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং অঙ্গহানির আশঙ্কা করলেও শুক্রবার বন্ধের দিন হওয়ায় পঙ্গু হাসপাতালে তার জরুরি অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। হাতে প্লাস্টার করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ফ্লাইট অবতরণের পর চালকের অনুপস্থিতির কারণে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেও পাওয়া যায়নি, শুক্রবার হওয়ায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির মেডিকেল সেন্টারও বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে অন্য কেবিন ক্রুদের মধ্যে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম জানিয়েছেন, মিথিলা আবুধাবি ফ্লাইটে ফেরার পথে টার্বুলেন্সে পড়ে গুরুতর আহত হন। বিমানবন্দর থেকে তাকে সরাসরি পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
আহত কেবিন ক্রুর চিকিৎসার বিষয়ে জানতে বিমান মেডিকেল সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার তাসলিমা আখতারকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার খায়রুন্নাহারকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কোনো কর্মীর আহত হওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই। তাছাড়া শুক্র ও শনিবার মেডিকেল সেন্টার বন্ধ থাকে।’
মাঝেমধ্যেই উড়োজাহাজ টার্বুলেন্সের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে ঝাঁকুনির খবর মিললেও এবারই প্রথম ঢাকার আকাশে বড় ধরনের এই টার্বুলেন্স দুর্ঘটনায় পড়ল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি। এর আগে গত বছরের মে মাসে মাঝ আকাশে মারাত্মক টার্বুলেন্সের শিকার হয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের এক যাত্রীর মৃত্যু ও বেশ কয়েকজন আহত হন। তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়।
এভিয়েশনের ভাষায় দুই বিপরীতমুখী বাতাসের সংঘর্ষের কারণে তৈরি হওয়া বায়ুর এক ধরনের অনিয়মিত প্রবাহকে টার্বুলেন্স বলা হয়। বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহের এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যে উড়োজাহাজ এসে পড়লেই এক বা একাধিক মারাত্মক ঝাঁকুনি লাগতে পারে। উড়োজাহাজে গতিবিধি ও উচ্চতায় আকস্মিক পরিবর্তনের পাশাপাশি এক ধাক্কায় উড়োজাহাজ কয়েক হাজার ফুট নীচে নেমে যেতে পারে। বাতাসের চাপ খুব বেশি থাকলেও উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কোনো সংকেত ছাড়াই এমনটা ঘটার কারণে সাধারণত পাইলটদের কিছু করারও থাকে না। এই টার্বুলেন্সের সময় যাত্রীদের সিটবেল্ট না থাকলে হতাহতের মতো ঘটনা ঘটে।
আজকাল উড়োজাহাজে হঠাৎ ঝাঁকুনি কেন এত বেড়ে গেছে
আবহাওয়াজনিত কারণে এই ধরনের ঝাঁকুনি স্বাভাবিক হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বেড়েছে। শুধু বিশেষজ্ঞই নন, নিয়মিত আকাশপথে ভ্রমণ করেন এমন অনেকেই বিষয়টি খেয়াল করেছেন বলেও জানিয়েছেন। আগে যেসব রুট তুলনামূলকভাবে মসৃণ ছিল, এখন সেখানেও টার্বুলেন্স বা হঠাৎ কাঁপুনির শিকার হতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো—আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় উড়োজাহাজের ঝাঁকুনি কেন আজকাল বেড়ে গেল?
বিমান চলাচলে টার্বুলেন্স নতুন কোনো বিষয় নয়। আকাশে বাতাস সব সময় সমানভাবে প্রবাহিত হয় না। কখনো মেঘের ভেতর দিয়ে, কখনো পাহাড়ি বায়ুপ্রবাহের কারণে কিংবা বড় কোনো বিমানের পেছনের ঘূর্ণিতে পড়ে যাত্রীবাহী বিমান হঠাৎ ঝাঁকুনি খায়। তবে ‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ জার্নালে প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি অব রিডিং-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই স্বাভাবিক ঘটনাই এখন আরও ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ায় বায়ুমণ্ডলে অস্থিতিশীলতা বেড়ে গেছে। উষ্ণ বাতাস ওপরে উঠে এবং ঠান্ডা বাতাস নিচে নেমে আসতে গিয়ে আকাশে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেটিই বিমানের যাত্রাকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স বা পরিষ্কার আকাশে ঝাঁকুনি। আগে ধরে নেওয়া হতো, মেঘের ভেতর বা বজ্রঝড়ের কাছে গেলে কাঁপুনি হবে, কিন্তু এখন ঝকঝকে আকাশেও বিমান হঠাৎ প্রবলভাবে কেঁপে উঠছে।
২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে গত চার দশকে ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স প্রায় ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো জেট স্ট্রিমের পরিবর্তন। উচ্চ আকাশে যে সরু ও দ্রুত বায়ুপ্রবাহকে জেট স্ট্রিম বলা হয়—সেটির গতি ও পথ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। ফলে পাইলটেরা অনেক সময় আগাম ধারণা না পেয়েই ঝাঁকুনির মধ্যে পড়ছেন।
যাত্রীদের দৃষ্টিতে এই অভিজ্ঞতা আতঙ্কজনক। হঠাৎ কাঁপুনিতে বিমানের ভেতরে অনেক সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিশেষজ্ঞরা আশ্বস্ত করে বলছেন, আধুনিক বিমান এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যেন টার্বুলেন্সে কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার ওপরও আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা না হলে হঠাৎ ঝাঁকুনিতে অনেকেই ছিটকে পড়ে আঘাত পান।
তবে ঝাঁকুনির বাড়তি প্রবণতা বিমান শিল্পের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন রুট পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কারণ যাত্রীদের আরাম ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আকাশে বাড়তি অস্থিরতা মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আর জলবায়ু পরিবর্তনের গতি থামানো না গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঝাঁকুনি আরও ঘন ঘন দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকেরা।