■ কূটনৈতিক প্রতিবেদক ■
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানকে ভারত ভালোভাবে নেয়নি, সেই কারণেই ঢাকা-নয়াদিল্লির সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গোরের সঙ্গে বৈঠকে ভারত নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক মাস আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সার্জিও গোরকে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্ররা গত বছর যা করেছে, তা ভারত পছন্দ করেনি। এ কারণেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যা তৈরি হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে অনেক ভুয়া খবর এসেছে। তারা প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে যে, গত বছরের গণঅভ্যুত্থান নাকি ইসলামি আন্দোলন।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের আন্দোলন হয়েছে বলে অপপ্রচার করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা বলেছে, এরা তালেবান এবং এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
‘তারা এমনটাও বলেছে, আমিও একজন তালেবান। আমার দাড়ি নেই, মাত্রই তা বাড়িতে রেখে এসেছি,’ রসিকতার সুরে বলেন তিনি।
ড. ইউনূস আরও অভিযোগ করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়েছে। তার ভাষায়, ‘ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে, যিনি সমস্যার সৃষ্টি করছেন। এগুলো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করেছে।’
এছাড়া বৈঠকে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট সার্ককে পুনর্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে তার দাবি, ভারতের অবস্থানের কারণেই এ জোট কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। তিনি বলেন, সার্ক কাজ করছে না কারণ একটি দেশের রাজনীতির সঙ্গে এটি ফিট হচ্ছে না।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে নির্ধারিত সম্মেলনটি উরির সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে কার্যত জোটটি অচল হয়ে পড়ে।
ভারত যদিও এখনও সার্কের সদস্য, তবে তারা পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে গড়ে ওঠা বিমসটেক-কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ।
সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকও করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস জানান, সার্কের পাশাপাশি এশিয়ার আরেক জোট আসিয়ানে যোগ দেওয়ার আগ্রহও বাংলাদেশ দেখাচ্ছে।
স্থানীয় সময় বুধবার নিউইয়র্কে এশিয়া সোসাইটি ও এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউট আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এসব কথা বলেন অধ্যাপক ইউনূস। এশিয়া সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিউং–ওহা ক্যাং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারাকে পরিচয় করিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ সময় সার্কসহ আঞ্চলিক সংস্থার গুরুত্বও তুলে ধরেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আঞ্চলিক অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশও আপনার দেশে বিনিয়োগ করবে। এটাই সার্কের ধারণা।’
সার্ক সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সার্কের পুরো ধারণা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে এবং বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজধানীতে রাজধানীতে এই ধারণা প্রচার করেছে। তিনি বলেন, সার্ক একটি পরিবারের মতো, যার মূল ভাবনা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একত্র করা। তরুণেরা যেন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে, শিক্ষা ও ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একে অপরের দেশে সফর করা, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়াশোনা করা এবং দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এটাই মূল ধারণা। তবে কিছুকাল আগে এটি কোনো এক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খায়নি। তাই আমরা এটিকে স্থগিত করতে বাধ্য হই। আমরা দুঃখিত এবং সবাইকে আবারও একত্র করতে চাই। এটাই আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধানের একমাত্র পথ।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘আমি বললাম, নেপাল, ভুটানের মতো প্রতিবেশী এবং ভারতের সাতটি রাজ্যের দিকে তাকাচ্ছেন না কেন। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সাতটি রাজ্য রয়েছে, যেগুলোর সাগরের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। এগুলো স্থলবেষ্টিত অঞ্চল।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আসিয়ানের বর্তমান চেয়ার মালয়েশিয়া। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সমঝোতায় আসা সহজ নয়, বিশেষ করে মিয়ানমার, যাদের রোহিঙ্গাবিষয়ক সমস্যা রয়েছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সে কারণে তারা হয়তো এগিয়ে আসবে না, তবে আমরা কাজ চালিয়ে যাব। আমরা মনে করি না, এটি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। আমাদের তা করার দরকার নেই। তাই সব সমস্যা সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গারা চাইলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে, তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও পেশায় ফিরে যেতে পারবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের মিয়ানমারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকবে। একে অপরের সঙ্গে বিরোধ করা কারও জন্যই উপকারী নয়। তাই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
বাংলাদেশের আসিয়ানের অনানুষ্ঠানিক সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা এটা করতে পারি। আসিয়ান একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আঞ্চলিক সমন্বয় ও আন্তসংযোগ গড়ে তোলা সম্ভব।’