■ ফজলে এলাহী পাপ্পু ■
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দুই কিংবদন্তী এক ফ্রেমে। একজন পর্দার সামনের মানুষ যিনি দর্শকদের খুব পরিচিত ও প্রিয়জন এবং সেকাল-একাল সব প্রজন্মের দর্শকেরা চেনে, অন্যজন পর্দার পেছনের মানুষ যার নাম বললে ৭০-৯০ দশকের সিনেমা দর্শকেরা চিনবেন কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে যিনি একদম অচেনা অজানা।
অভিনেত্রী ববিতা যার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দার আড়ালে থাকা এক কিংবদন্তী যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আজ থেকে ১২ বছর আগেই। বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দার সামনে ও পেছনের দুই কিংবদন্তি একই ফ্রেমের স্মরণীয় একটা ছবি নিচের ছবিটি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও জীবন্ত কিংবদন্তী ববিতাকে যার দিকে তাকিয়ে আছেন সেই মানুষটাকে আজকের তথাকথিত চলচ্চিত্রপ্রেমিরা চিনে না , এমনকি আমার সমবয়সী বাংলা সিনেমা পাগল মানুষগুলোও ঐ মানুষটিকে নামে সবাই চিনলেও চেহারায় অনেকেই চিনে না । ববিতার পাশে বসা মানুষটি হলো বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের পর্দার পেছনে থাকা সেরা মেধাবী ও কিংবদন্তীতুল্য মানুষগুলোর অন্যতম একজন যার নাম আহমেদ জামান চৌধুরী । যাকে চলচ্চিত্রের সবাই ‘’আজাচৌ’’ নামে ডাকতো । বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় করার পেছনে এই মানুষটির অবদান অনস্বীকার্য যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন । ৭০ – ৯০ দশক এই তিনটি দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রতিনিধিত্ব করা জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘’চিত্রালী’র সম্পাদক ছিলেন এই আহমেদ জামান চৌধুরী। আহমেদ জামান চৌধুরী হলেন বাংলাদেশের সোনালি যুগের বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার গীতিকার ও সংলাপ রচয়িতা । এছাড়াও তিনি সম্পর্কে অভিনেত্রী দিলারা জামানের দেবর।
বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনী লেখার প্রথাটা ভাঙেন আহমেদ জামান চৌধুরী। নিয়ম ভেঙে গল্পের লাইনআপ করা বাদ রেখে সংলাপসহ পূর্ণ দৃশ্যপরিকল্পনা দিয়ে পাণ্ডুলিপি রচনা করলেন ” যাদুর বাঁশি” চলচ্চিত্রে। এ প্রসঙ্গে পরিচালক আবদুল লতিফ বাচ্চু বলেছিলেন ” এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে জাদুর বাঁশির লেখা বহুবার থেমে গিয়েছিল। তবুও শিল্পীর স্বভাবে সুস্থির খোকা ভাই ঠিকই সাফল্যে পৌঁছেছিলেন।” ” যাদুর বাঁশি” চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর শিল্প সৃষ্টির ক্ষিপ্রতা, যা ফিকশন স্টোরি লেখার এক ধরনের কৌশল। বারবার কল্পনায় বাস্তবতা নির্মাণ, আবার নির্মাণকে গুচ্ছিতভাবে পূর্ণরূপ দিতে পূনর্নির্মাণ করা—চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনার এসব লজিক্যাল অথবা ফিলোসফিক্যাল গঠনমূলক চিন্তাশক্তি ছিল বিধায় লেখার ক্ষেত্রে পরিচালক, প্রযোজক অথবা শিল্পীদের প্রভাবিত করা তাঁর পক্ষে সহজ কর্ম ছিল।
আহমেদ জামান চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর চাঁদপুরে । পাঁচ ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে আহমদ জামান চৌধুরীর অবস্থান সর্বকনিষ্ঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন তিনি। ১৯৭০ সালে ‘সাপ্তাহিক চিত্রালী’র মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন । এরপর নানা দায়িত্ব পালন শেষে পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন দীর্ঘ ১০ বছর। সব মিলিয়ে চিত্রালীর সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন দীর্ঘ ২০ বছর। চিত্রালীর পর তিনি দু’বছর ফিচার এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়। প্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী ছিলেন আজাচৌ নামে খ্যাত। তিনি এই নামে চিত্রালীতে ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ শিরোনামে সিনেমা সংশ্লিষ্ট লেখা লিখতেন। এছাড়াও তিনি দৈনিক ‘’আমার দেশ‘’ পত্রিকায় খাসওয়ালাদের খাস খবর নামে রাজনীতির পাতায় ব্যঙ্গাত্মক কলাম লিখতেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণী পেয়ে পাস করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু শিক্ষকতা যেন তার ধাতে সয় না। তাকে টানে চলচ্চিত্র জগৎ। সিনেমা জগতে রঙ্গিন আকর্ষণের টানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা লোভনীয় পদ ছেড়ে যোগ দেন সাপ্তাহিক চিত্রালীতে। সেই সময় সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত সিনেমা সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ।
চিত্রালীর সম্পাদকের পরলোকগমনের পর ১৯৭৮ সালে আহমেদ জামান চৌধুরী তিনি সম্পাদক হন। সেই থেকে শুরু। তারপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছর তিনি উক্ত পদে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আহমেদ জামান চৌধুরীর লেখা প্রথম কাহিনী চিত্রনাট্য ‘ছবি নতুন নামে ডাকো।’ এছাড়াও তাঁর লিখা গল্প ও চিত্রনাট্যে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে পিচঢালা পথ, নাচের পুতুল, বাঁদি থেকে বেগম, আগুন,মাস্তান, তুফান, যাদুর বাঁশি , শেষ উত্তর, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, শ্বশুর বাড়ি, মিস লঙ্কা, রাতের পরদিন, দূরদেশ, সুখ-দুঃখের সাথীসহ, রাঙা ভাবী’র মতো অনেক সুপারহিট চলচ্চিত্র। তাঁর লিখা কাহিনী ও সর্বপ্রথম প্রযোজিত ‘’যাদুর বাঁশি’’ চলচ্চিত্রটি শুধু দর্শক নন্দিত হয়নি পেয়েছিল একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার । তিনি এ যাবৎ শতাধিক চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখে ঢাকার চলচ্চিত্রকে করেছেন ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ।
বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনী লেখার প্রথাটা ভাঙেন আহমেদ জামান চৌধুরী। নিয়ম ভেঙে গল্পের লাইনআপ করা বাদ রেখে সংলাপসহ পূর্ণ দৃশ্যপরিকল্পনা দিয়ে পাণ্ডুলিপি রচনা করলেন ” যাদুর বাঁশি” চলচ্চিত্রে। এ প্রসঙ্গে পরিচালক আবদুল লতিফ বাচ্চু বলেছিলেন ” এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে জাদুর বাঁশির লেখা বহুবার থেমে গিয়েছিল। তবুও শিল্পীর স্বভাবে সুস্থির খোকা ভাই ঠিকই সাফল্যে পৌঁছেছিলেন।” ” যাদুর বাঁশি” চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন। এটাই ছিল তাঁর শিল্প সৃষ্টির ক্ষিপ্রতা, যা ফিকশন স্টোরি লেখার এক ধরনের কৌশল। বারবার কল্পনায় বাস্তবতা নির্মাণ, আবার নির্মাণকে গুচ্ছিতভাবে পূর্ণরূপ দিতে পূনর্নির্মাণ করা—চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনার এসব লজিক্যাল অথবা ফিলোসফিক্যাল গঠনমূলক চিন্তাশক্তি ছিল বিধায় লেখার ক্ষেত্রে পরিচালক, প্রযোজক অথবা শিল্পীদের প্রভাবিত করা তাঁর পক্ষে সহজ কর্ম ছিল।
১৯৮৯ সালে শাবানা “রাঙা ভাবী” চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনা শুরু করেন। চলচ্চিত্রটির জন্য লোকেশন নির্বাচন করা হলো নেপাল। আহমেদ জামান চৌধুরী জানালেন, নেপালের লোকেশনে থেকে তাঁকে লিখতে হবে। নির্ভেজাল কিছু যৌক্তিক কারণে প্রযোজক শাবানা ওই শর্তে তাঁকে নেপালে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তাঁর লেখা ব্যাপক জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে রয়েছে পিচঢালা এ পথটারে ভালবেসেছি, যেও না সাথী, নতুন নামে ডাকবো তোমায়, কে তুমি এলে গো, ও দরিয়ার পানি, এ বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না, চুরি করেছো আমার মনটা, মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, যাদু বিনা পাখি যেমন বাঁচিতে পারে না, এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও, বিদায় দাওগো বন্ধু তোমরা এবার দাও বিদায়, প্রেম পিরিতি চাই বলে সবাই আমায় পাগল বলে, আমার যা কিছু সবই যে তোমার জন্য , তোমাদের এই খুশির আসর , রাঙাভাবী মা বাঁধন খোলো না।
রাজ্জাক এর ”নায়করাজ” , মাসুদ পারভেজ এর ‘সোহেল রানা ‘ নাম ও ‘ড্যাশিং হিরো’ উপাধি, উজ্জ্বলের ‘ মেগাস্টার’’ , ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘’ সুপারস্টার’’, শাবানার ‘’বিউটি কুইন’’, জাসিমের ‘’অ্যাকশন কিং’’ , পরিচালক এ জে মিন্টুকে ‘’মাস্টার মেকার’’ সহ জনপ্রিয় সকল ব্যক্তিবর্গের উপাধিগুলো এই মানুষটারই দেয়া তা হয়তো অনেকেই জানেন না। আজ আহমেদ জামান চৌধুরী নেই কিন্তু তাঁর কর্মগুলো রয়ে গেছে আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যা চিরদিন থাকবে ।
২০১৩ সালের ৬ই মার্চ আহমেদ জামান চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। আজ চলচ্চিত্রে যখন নকল ছবির গল্প নিয়ে সোচ্চার তখন কেউ কি একজন আহমেদ জামান চৌধুরীর কাজগুলো থেকে কি কোন শিক্ষা বা প্রেরণা নিয়েছেন কি কিভাবে মৌলিক গল্প লিখা যায় ? বিদেশীদের কাছ থেকে তো অনেক কিছুই শিখলেন এবার না হয় আমাদের দেশের গুণীদের কাছ থেকে কিছু শিখুন।