■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
সর্বশেষ গাজা অভিমুখী আন্তর্জাতিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ঘিরে ফেলেছে ইসরায়েলি যুদ্ধজাহাজ। গ্লোবাল সলিডারিটি ফ্লোটিলা (জিএসএফ)-এর মুখপাত্র সাইফ আবুকেশক বলেন, মানবিক এই মিশন সরাসরি সাগরে ইসরায়েলি বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছে। খবর পেয়েছি কিছু জাহাজকে সামরিক বাহিনী ঘিরে ফেলেছে।
গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা আন্তর্জাতিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ৪৪টি দেশের ৫৫টি জাহাজ নিয়ে গঠিত এই নৌবহরে তিনি একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন।
মঙ্গলবার ইতালির উপকূলীয় শহর ওট্রান্টো থেকে ফ্লোটিলার বৃহত্তম জাহাজ ‘কনসায়েন্স’-এ যোগ দিয়েছেন তিনি। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ তথ্য জানান।
ফ্লোটিলা থেকে তিনি একটি ছবি শেয়ার করেছেন। যেখানে দেখা যায়, তিনি বুকে লাল-সবুজ পতাকা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এবং পরনে শহীদ আবু সাঈদের ছবিযুক্ত একটি টি-শার্ট।
মানবিক সহায়তার বার্তা পৌঁছে দিতে সাংবাদিক, শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ স্বেচ্ছাসেবীরা এই ফ্লোটিলায় যোগ দিয়েছেন। তাদের লক্ষ্য—যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।
গ্লোবাল মিডিয়া ফ্লোটিলাতে যোগদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে গণহত্যা চলছে। ইসরায়েল ও আমেরিকা একসঙ্গে ফিলিস্তিনে, গাজায় মানুষকে খুন করছে। তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের অনেকগুলো দেশ যুক্ত, তারাও সহযোগিতা করছে এবং তারাও এতে অংশীদার। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক মানুষ– সারা পৃথিবীর মানুষ এর প্রতিবাদও করছে এবং এই প্রতিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখে আমি আগামীকাল মিডিয়া ফ্লোটিলায় যোগ দিতে যাচ্ছি।’
শহিদুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আমি প্রথম যাচ্ছি, কিন্তু মনে করি বাংলাদেশের সকল মানুষের ভালবাসা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। এই সংগ্রামে শুধু আমাদের থাকলেই হবে না, এতে যদি আমরা পরাজিত হই, তাহলে মানবজাতি পরাজিত হবে।’
এই মিডিয়া ফ্লোটিলাতে কারা কারা আছে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে শহিদুল আলম বলেন, ‘এরমধ্যে ৪৪টি দেশের কথা বলা হয়েছে, এখন ৪৫টি দেশ হবে। সঠিক সংখ্যাটি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। তবে আমি যার কথা বলছি সেটি এখন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সঙ্গে যুক্ত হবে, যেটি মিডিয়া ফ্লোটিলা, একটি বড় নৌকা। এর সঙ্গে ছোট আরও ১০টি নৌকা থাকবে।’
তিনি আরও জানান, দৃক বহুবছর ধরেই ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে বাংলাদেশ থেকে সংহতি বজায় রেখেছে।
‘ফিলিস্তিনের ওপর ক্রমাগত আক্রমণকে আমাদের ওপরেই আক্রমণ মনে করেছি। একটি সমষ্টিগত আন্দোলনের জায়গা থেকে আমরা আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ফিলিস্তিনভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাক্টিভিজম জারি রেখেছি।’
শহিদুল আলমের ভূয়সী প্রশংসা ঢাকার ফিলিস্তিনি দূতাবাসের
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার লক্ষ্যে ত্রাণবাহী নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় যোগ দেয়ায় বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমের ভূয়সী প্রশংসা করেছে ঢাকার ফিলিস্তিনি দূতাবাস।
বুধবার (১ অক্টোবর) ফিলিস্তিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি আলোকচিত্রী, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমকে গর্বের সাথে ধন্যবাদ জানায়, যিনি গ্লোবাল সুমুদ মিডিয়া ফ্লোটিলায় যোগ দিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলের অবৈধ অবরোধ ভাঙার এই ঐতিহাসিক মিশনে অংশ নেয়া প্রথম বাংলাদেশি তিনি। ন্যায়বিচারের জন্য তার নির্ভীক কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
ফ্লোটিলা ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের হুমকির মুখেই গাজা অভিমুখে এগিয়ে চলছে ক্ষুধার্ত বাসিন্দাদের জন্য ত্রাণবাহী জাহাজ বহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। বুধবার ১২০ নটিক্যাল মাইল বা ২২২ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসার পর বহরের একজন কর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে ইসরায়েলের হুমকির কথা জানান। ওই কর্মী হলেন প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালের সহসাধারণ সমন্বয়কারী ডেভিড অ্যাডলার। এক চিঠিতে তিনি ইসরায়েলের হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ইতোমধ্যে ইসরায়েলের কয়েকটি জাহাজ ফ্লোটিলাকে ঘিরে ধরেছিল। তারা ক্রুদের ভয় দেখায় এবং বহরের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। এ সময় বহরের কর্মীদের জীবন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন অ্যাডলার।
এদিকে ফ্লোটিলা ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট জানিয়েছে, তেলআবিব থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণের আশদোদ বন্দরে প্রায় ৫০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা আশদোদ ও আশপাশের হাসপাতালগুলোকে সতর্ক থাকতেও নির্দেশ দিয়েছে।
গণমাধ্যমটি জানায়, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর এলিট স্পেশাল ফোর্স ইউনিট শায়েতেত-১৩ এর সদস্যরা ফ্লোটিলার জাহাজগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেবে। বহরের কর্মীদের ইসরায়েলি নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে তীরে নেওয়া হবে এবং তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। আর যারা আদেশ মেনে কাজ করবে তাদের ফেরত পাঠানো হবে। কিছু জাহাজকে তীরে টেনে আনা হবে এবং অন্যগুলো সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হতে পারে। ফলে বহরের ৪৯৭ যাত্রী জীবন শঙ্কায় রয়েছেন। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সার নৌ-বহরকে থামানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ইতালি এবং গ্রীস ইসরায়েলকে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে এবং জানিয়েছে যে, তারা ঘটনাবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
ডেভিড অ্যাডলার তার চিঠিতে বলেন, ‘আমি আশঙ্কা করছি এটিই হবে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আপনাকে লেখা আমার শেষ চিঠি। আমরা গাজার উপকূল থেকে এখন মাত্র ১২০ নটিক্যাল মাইল দূরে। গত রাতে বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি নৌবাহিনীর জাহাজ আমাদের বহরকে বাধা দিয়েছিল। তারা আক্রমণ করেছিল, ক্রুদের ভয় দেখিয়েছিল এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।‘
জাহাজে থাকা একজন কর্মী রুস ইয়েকেমা ইনস্টাগ্রামে বলেন, ‘আমরা ইসরায়েল প্রভাবিত অঞ্চলে (মিশরের জলসীমার কাছাকাছি) প্রবেশ করেছি। আগামী ৪৮ ঘণ্টা আমাদের ওপর নজর রাখুন। এখনই ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙার সময়।
ফ্লোটিলার একটি জাহাজের কর্মী স্যামুয়েল রোস্টল আল জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলি হুমকির মুখে জাহাজের প্রায় সব ক্রু রাতের বেশিরভাগ সময় জেগে কাটিয়েছেন।
জাহাজ আলমায় থাকা থিয়াগো আভিলা বলেন, ইসরায়েলের বাধা দেওয়ার সময় নৌকার ডিভাইসগুলো অচল হয়ে যায়। ক্যামেরা, লাইভস্ট্রিম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করছিল না। আরেক যাত্রী লিসি প্রোয়েনকা বলেন, ইসরায়েলি একটি জাহাজ প্রায় ১৫ মিনিট ধরে বহরের চারপাশে চক্কর দিয়েছিল। অন্যরা জানান, বেশ কয়েকটি অজ্ঞাত জাহাজ আলো ছাড়াই নৌবহরে বাধা দেয়।
ফুটেজে দেখা গেছে, ফ্লোটিলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তুরস্কের নৌবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। ফ্লোটিলায় কমপক্ষে ৪৪টি দেশের কর্মী, সাংবাদিক এবং শিল্পী রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গ ও নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা।
ফ্লোটিলার সঙ্গে যুক্ত ছিল ইতালীয় নৌবাহিনীর ফ্রিগেট। কিন্তু ইতালীয় কর্মকর্তারা উপকূলরেখা থেকে ১৫০ নটিক্যাল মাইল (২৭৮ কিমি) দূরত্বে আসামাত্রই তারা নৌবহর ত্যাগ করে।
ফ্লোটিলা রক্ষার আহ্বান
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। অস্ট্রেলিয়া ফ্লোটিলায় ড্রোন হামলার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশটির ছয় জন নাগরিক জাহাজ বহরে যুক্ত আছেন। ফরাসি এমপি মাথিল্ডে প্যানোট ফ্লোটিলার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো ফ্লোটিলায় থাকা শত শত মানুষের জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
পোপ লিও চতুর্দশও নৌবহরের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আশা করি সহিংসতা হবে না, মানুষকে সম্মান করা হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে রোববার বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গ্রেটা থানবার্গ এই নৌবহরকে একটি প্রচারণামূলক পদক্ষেপ আখ্যা দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, আমি মনে করি না কেউ প্রচারের জন্য জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
গত ৩১ আগস্ট স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা এখন পর্যন্ত গাজায় সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক মিশন। এত ৪৪ জাহাজে ৪৯৭ জন যাত্রী রয়েছে। গত জুন ও জুলাই মাসে গাজায় জাহাজে করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার আরও দুটি প্রচেষ্টা আটকে দিয়েছিল ইসরায়েল।