একটি ছাড়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সব জাহাজ আটক

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

ফিলিস্তিনের গাজার উদ্দেশে রওনা করে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বিশাল বহরের যাত্রায় টিকে আছে আর মাত্র একটি নৌযান। সেটি গাজার খুব কাছে জলসীমায় ভাসছে। ইসরায়েল বলছে, অল্প সময়ের মধ্যে এ পর্বও শেষ হবে।

শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবরোধ ভাঙার উদ্দেশে গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা মানবিক সহায়তা বহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। তারা বহর থেকে অন্তত ২২৩জন কর্মীকে আটক করেছে। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে বইছে ক্ষোভ, নিন্দা জানিয়েছেন নেতারা।

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামুদ্রিক অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা কোনো বড় ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ‘উস্কানি’ শেষ হয়েছে। হামাস-সুমুদের কোনো উস্কানিমূলক নৌকা সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ বা ‘বৈধ নৌ অবরোধ’ ভাঙার প্রচেষ্টায় সফল হয়নি।

মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সব যাত্রী নিরাপদ এবং সুস্থ আছেন। তারা নিরাপদে ইসরায়েলে যাচ্ছেন। সেখান থেকে তাদের ইউরোপে পাঠানো হবে। সম্ভাব্য যান্ত্রিক সমস্যাযুক্ত একটি জাহাজ গাজা থেকে কিছু দূরে সমুদ্রে রয়ে গেছে। যদি এটি কাছে আসে, সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা করে তবে সেটি প্রতিরোধ করা হবে।

ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির ঘণ্টাখানেক আগে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ট্র্যাকার ৪৪টি নৌকার বহরের প্রায় সব জাহাজের অবস্থা পরিবর্তন করে ইসরায়েলি নৌবাহিনী কর্তৃক ‘নিশ্চিত বাধাপ্রাপ্ত’ অথবা ‘সম্ভাব্য বাধাপ্রাপ্ত’ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তখন বলা হয়, সামারটাইম-জং এবং শিরিনসহ চারটি জাহাজ এখনো চলাচল করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুটি জাহাজই আইনজীবীদের বহনকারী আইনি সহায়তাকারী নৌকা। ফিলিস্তিনের জলসীমায় প্রবেশকারী প্রথম ফ্লোটিলা জাহাজ মাইকেনো এবং ম্যারিনেটও এখনো এগোচ্ছে বলে দাবি করা হয়।

তবে ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির পর ট্র্যাকারটি বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ তাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে নৌযানের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট পেজে কেবল মানচিত্র প্রদর্শন হচ্ছে। কোনো জাহাজ ট্র্যাক বা বর্তমান অবস্থা দেখানো হচ্ছে না। অবশ্য কিছু সময় পর সেটি আবারও সক্রিয় হয়।

এদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, নৌবহর থেকে আটক গাজার কর্মীরা নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। নৌবাহিনীর কমান্ডোরা সমুদ্রে তাদের আটক করার পর কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। আটক গাজা কর্মীদের আশোদ বন্দরে আনা হচ্ছে। তাদের সবাইকে নিরাপদে ইউরোপে পাঠানো হবে।

প্রথম দফায় আটক নৌযানগুলো আজ স্থানীয় সময় দুপুরের মধ্যে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। বন্দরটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। ইসরায়েল জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের প্রক্রিয়া শেষে উড়োজাহাজে করে ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

গাজা থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরে থাকা অবস্থায় গতকাল রাতে ফ্লোটিলায় প্রথমবারের মতো সরাসরি বাধা দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ। এই নৌবহরে রয়েছে ৪০টির বেশি বেসামরিক নৌযান। বহরে প্রায় ৪৪টি নৌযানে ৫০০ মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের নাগরিকসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক রয়েছেন।

আন্তর্জাতিক জলসীমা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ

কোনো উপকূলবর্তী দেশ তার তীর থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (২২ কিমি) পর্যন্ত পানিসীমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ভোগ করে—এটি আঞ্চলিক জলসীমা নামে পরিচিত।

এর বাইরে ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০ কিমি) পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড)। যেখানে মাছ ধরা, খনিজ আহরণ, জ্বালানি অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রের অধিকার থাকে। তবে অন্যান্য দেশের নৌযান অবাধে চলাচল করতে পারে।

সমুদ্রের প্রায় ৬৪ শতাংশ অঞ্চল আন্তর্জাতিক জলসীমা, যেখানে কোনো রাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণ নেই। এই অঞ্চলের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সমুদ্র আইন কী বলে?

১৯৮২ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (UNCLOS) অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জলসীমায় সব রাষ্ট্রের নৌযান চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল জলদস্যুতা বা অনুমোদনহীন কর্মকাণ্ড।

আগের ফ্লোটিলায় হামলা

২০১০ সাল থেকে গাজার অবরোধ ভাঙতে একাধিক ফ্রিডম ফ্লোটিলা পাঠানো হয়েছে, যেগুলো সবই আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি বাধার শিকার হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ৩১ মে। ওই দিন আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাভি মারমারা জাহাজে হামলা চালিয়ে ইসরায়েলি কমান্ডোরা ১০ কর্মীকে হত্যা করেন এবং ১২-১৫ জনকে আহত করেন।

২০২৪ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ঘোষণা দেন, ফ্রিডম ফ্লোটিলার আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবাধ চলাচলের অধিকার রয়েছে এবং ইসরায়েল কোনোভাবেই এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

আন্তর্জাতিক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের (আইটিএফ) মহাসচিব স্টিফেন কটন বলেন, সমুদ্র আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় অহিংস ও মানবিক জাহাজে হামলা বা দখল বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। এতে শুধু জীবন ঝুঁকিতে পড়ে না, বরং সমুদ্রপথে বৈশ্বিক নিরাপত্তার মূলনীতিও ভেঙে যায়।

কোন কোন আইনে এই মিশন বৈধ

ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের মতে, সুমুদ ফ্লোটিলা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত। যেমন—UNCLOS (১৯৮২): আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলাচলে স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়।

সান রেমো ম্যানুয়াল: এমন অবরোধ নিষিদ্ধ করে, যা অনাহার বা অযথা ভোগান্তি সৃষ্টি করে এবং নিরপেক্ষ মানবিক মিশনকে লক্ষ্যবস্তু করা থেকে বিরত থাকতে বলে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ২৭২০ ও ২৭২৮: মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশ ও সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণের দাবি জানায়।

জেনোসাইড কনভেনশন: ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের বিপন্ন করার কাজ প্রতিরোধের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে।

চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন: মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

রোম স্ট্যাটিউট (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত): যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অনাহার সৃষ্টি ও মানবিক সহায়তা ব্যাহত করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *