সাহিত্যে নোবেল পেলেন লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (László Krasznahorkai)। সুনিশ্চিত ও দিব‍্যদৃষ্টিপূর্ণ সাহিত্য সম্ভারের কারণে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়ার কথা জানিয়েছে নোবেল কমিটি।

বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১২২তম লেখক হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার পাবেন ক্রাসনাহোরকাই। গত বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক, কবি হান কাং।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাফকা এবং টমাস বার্নহার্ডের প্রভাব দেখা যায়। লাসলো ক্রাসনাহোরকাই মধ্য ইউরোপীয় ঐতিহ্যের একজন মহাকাব্যিক লেখক।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার ধরণ অদ্ভুত। তাঁকে নোবেল কমিটি বলেছেন ‘চিন্তাশীল, সূক্ষ্মভাবে পরিমিত স্বর গ্রহণকারী’।

ক্রাসনাহোরকাইরের সর্বশেষ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস জস্মলে ওদাভান পাঠককে আবার হাঙ্গেরিতে ফিরিয়ে নেয়।

এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ৯১ বছর বয়সী আঙ্কল জোজসি কাদা সিংহাসনের গোপন দাবিদার, কিন্তু তিনি বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য হয়ে থাকতে মরিয়া চেষ্টা চালি যান।

লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলাতে জন্মগ্রহণ করেন। জিউলার মতোই একটি প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল হলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রথম উপন্যাস সাতানটাঙ্গোর (১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত) প্রেক্ষাপট।

এই উপন্যাসে উঠে এসেছে হাঙ্গেরির একটি গ্রামীণ পরিত্যক্ত সমবায় খামারে বাস করা দরিদ্র কিছু মানুষের কথা। সমাজতন্ত্রের পতনের ঠিক আগমুহূর্তে যাঁরা অনিশ্চয়তা ও নিরাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

সাতানটাঙ্গো হাঙ্গেরির সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের আলোচিত উপন্যাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই বইটি।

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য মেলানকোলি অব রেজিসট্যান্স (১৯৮৯ সালে প্রকাশিত, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৮) পড়ে আমেরিকান সমালোচক সুসান সোনট্যাগ তাঁকে বলেছিলেন সমসাময়িক সাহিত্যের ‘অ্যাপোক্যালিপসের মাস্টার’।

দ্য মেলানকোলি অব রেজিসট্যান্স-এ ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের চিত্র আঁকা হয়েছে। পাহাড়ে অবস্থিত একটি ছোট শহর কার্পাথিয়ানে প্রবেশ করে একটি প্রেতাত্মাসদৃশ সার্কাসদল, যার মূল আকর্ষণ একটি বিশাল তিমির মৃতদেহ। এই উদ্ভট এবং আশঙ্কাজনক ঘটনা শহরের ভেতর নানারকম ধ্বংসাত্মক শক্তিকে উসকে দেয়। সহিংসতা, অরাজকতা এবং সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা শহরটিকে নিয়ে যায় স্বৈরাচারী অভ্যুত্থানের দ্বারপ্রান্তে। লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে নৃশংস দ্বন্দ্ব, যা থেকে কেউই মুক্ত নয়।

তৃতীয় উপন্যাসে এসে লেখক বেছে নেন হাঙ্গেরির সীমানার বাইরের প্রেক্ষাপট। ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯ সালে প্রকাশিত, ইংরেজি অনুবাদ ২০০৬) নামের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন সাধারণ আর্কাইভ কর্মচারী। যিনি জীবনের অন্তিম মুহূর্তে নিউইয়র্কে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। 

এই উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় জন্ম নিয়েছে লেখকের উপন্যাস ‘ব্যারন ভেঙ্কহেইম’স হোমকামিং’ (২০১৬ সালে প্রকাশিত, ইংরেজি অনুবাদ ২০১৯)। উপন্যাসটির চরিত্রটি তার মাতৃভূমিতে (হাঙ্গেরি) ফিরছে। জুয়ার আসক্তিতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক জমিদার বহু বছর আর্জেন্টিনায় কাটিয়ে হাঙ্গেরিতে ফিরে আসছে শৈশবের প্রেমকে খুঁজতে। তবে তাঁর সফরসঙ্গী ‘দান্তে’ একটি ছলনাময় চরিত্র। দান্তে তাঁকে বিপথে নিয়ে যায়।  

এই লেখকের সাম্প্রতিকতম বই হেরস্ট ০৭৭৬৯ (২০২১ সালে প্রকাশিত, ইংরেজি অনুবাদ ২০২৪)-এর দৃশ্যপট পূর্ব জার্মানির থুরিঙ্গিয়ার একটি ছোট শহর। সমসাময়িক বাস্তবতা ও সামাজিক অস্থিরতায় পরিপূর্ণ এই শহরটি। গল্পের আবহে আছে সঙ্গীতজ্ঞ বাখ-এর সঙ্গীত ও ঐতিহ্যের ছায়া। এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র উপন্যাসে বুঝতে পারেন, তিনিও সেই ধ্বংসাত্মক শক্তিরই অংশ হয়ে গেছেন, যাদেরকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন।  

উল্লেখ্য, প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি- এই ছয় বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন; তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কার প্রদানের পর তা উদযাপনে উৎসবের আয়োজন করে নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির সদর দফতর নরওয়েতে।

উনবিংশ শতাব্দিতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাজারে যা প্রায় ১৮০ কোটি ক্রোনের সমান। আলফ্রেড নোবেলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার শুরু হয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। প্রথম দিন ঘোষণা করা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল।

ছয়টি বিভাগে ছয় দিন নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা হয় নরওয়ে থেকে। সাহিত্য ও অর্থনীতির মতো অন্য পুরস্কারগুলো সুইডেন থেকে ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।

১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১১৪টি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। ২২৭ জন বিজয়ীর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নারী।

শুরুতে নোবেল বিজয়ীদের প্রায় দেড় লাখ ক্রোনা দেওয়া হতো। বাড়তে বাড়তে ১৯৮১ সালে তা ১০ লাখ ক্রোনা হয়। এরপর পুরস্কারের আর্থিক মূল্য দ্রুত বাড়ানো হয়। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এর পরিমাণ ১ কোটি ক্রোনা হয়।

সর্বশেষ এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাড়ানো হয় নোবেল পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী। এ বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা মোট ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা (৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলার) পাবেন, যা আগের চেয়ে ১০ লাখ ক্রোনা বেশি। নোবেল ফাউন্ডেশনের তহবিলের উন্নতি হওয়ায় এ বছর পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ফাউন্ডেশনের তহবিলে টান পড়ায় ২০১২ সালে পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি ক্রোনা থেকে কমিয়ে ৯০ লাখ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে ৯০ লাখ এবং ২০২০ সালে ফের এক কোটিতে উন্নীত করা হয়।

গত এক দশকে ইউরোর বিপরীতে প্রায় ৩০ শতাংশ দর হারিয়েছে সুইডিশ ক্রোনা। ফলে পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ ক্রোনা বাড়ানো হলেও সুইডেনের বাইরে তা ততটা বাড়বে না।

২০১৩ সালে আর্থিক সম্মানী কমিয়ে ৮০ লাখ ক্রোনা করা হয়। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় এই পুরস্কারের পরিমাণ দাঁড়াত ১২ লাখ ডলার। সেটা বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনা হলেও বিনিময় হারের খেলায় ২০২৪ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ডলারের কম। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান খুব একটা বাড়েনি।

বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার মূল্যমান দাঁড়ায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *