■ ফিচার ডেস্ক ■
ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরাতন। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে কতশত ঘটনা, দুর্ঘটনা, ষড়যন্ত্র, বীরত্ব, আহাজারি, লুটতরাজ, দুর্যোগ, যুদ্ধ, বিগ্রহ, মহামারী, গণহত্যা, মানুষ বেচাকেনা, দাসত্ব, খুন, নিপীড়নসহ আরও নানা অপরাধ ঘটেছে। দুইদিন মানুষ শান্তিতে থাকলে তিনদিন পর নেমে আসত কোন না কোন বিপর্যয়। এসকল অগণিত ইতিহাসের ঘনঘটার মধ্য থেকে আজ ক্ষুদ্র একটা অংশ নিয়ে আলোচনা করবো।
পর্তুগিজ জলদস্যু হার্মাদ
সুজলা সুফলা বাংলার দিকে ভিনদেশীদের চোখ ছিল যুগ যুগ ধরেই। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর ভারতবর্ষ দখল দিয়ে এর সূচনা হয়। পর্তুগিজরা আসে আরও বহু পরে। পর্তুগিজ বণিকগণ বাংলায় আসে বানিজ্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে। অন্তত সবাই তাই ভেবেছিল। চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম ও হুগলিকে বাণিজ্য কেন্দ্র বানিয়ে ফেলে। যখন বুঝতে পারল এখানকার মানুষ নিরীহ, নিরস্ত্র-তখন খোলস পাল্টিয়ে তারা বনে যায় দস্যু। তারা ছিলই মূলত বণিকের ছদ্মবেশে একদল জলদস্যু। ইতিহাসের কুখ্যাত ডাকাত দল “হার্মাদ”। ১৫শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে তারা বাংলায় সীমাহীন লুটতরাজ আর একচেটিয়া দাস ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিল।
মগ দস্যু দল:
মায়ানমারের আরাকান রাজ্য সুপরিচিত সবার কাছেই। এই আরাকান রাজ্যের বাসিন্দারাই আদি “মগজাতি”। তাদের রাখাইন বা আরাকানিও বলা হতো। এরা ১৫০০খ্রি. থেকে ১৭০০খ্রি. পর্যন্ত অর্থাৎ মুঘল আমলে সুবেদার শায়েস্তা খান কর্তৃক দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার আগ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে মানুষ থেকে শুরু করে যাবতীয় ধন সম্পদ, সোনাদানা, গবাদি পশু, ফসল লুট করে নিয়ে যেত। তারা সমুদ্র পথে আসত। এই জলদ’স্যুর দল বাংলায় এক সীমাহীন আতঙ্কের “মগদস্যু” নামে পরিচিতি লাভ করে। এদের ভ’য়ংকর কর্মকান্ডের জন্য “মগের মুল্লুক” প্রবাদটি প্রচলিত হয়। যা দিয়ে চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বোঝায়।
মগদের অত্যাচার:
মগরা হার্মাদ দস্যুদের সাথে মিলে বাংলার মানুষদের ধরে নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিন। মৃ’ত্যুর আগে পর্যন্ত একজন মানুষও কখনও স্বদেশে ফিরে আসতে পারেনি। মানবপাচারের এই কাজটি তারা সম্পূর্ণ পরিচালিত করত সমুদ্র পথে।
ঢাকায় মগদের প্রবেশ:
রাজ্য বিস্তার করাই যে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তা বোঝা আরও পরে যখন তারা
১৬০০ সালের পর থেকে নিয়মিতই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও নারায়ণগঞ্জ সংলগ্ন এলাকায় হামলা, নৃশংসতা, লুটতরাজ চালাতেই থাকে। এ সময়টায় ঢাকা শহরের মানুষ সীমাহীন আতঙ্কে তটস্থ থাকত। প্রতি নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে কেউই রেহাই পেত না তাদের কাছ থেকে।
মগবাজার নামকরণ:
বারবার হামলার পর শেষ পর্যন্ত মগরা ঢাকার পূর্বাংশে বসতি গড়ে তোলে। সেখান থেকেই জায়গাটির নাম হয় “মগবাজার”। অর্থাৎ মগ দস্যুদের বসতির বাজার।
মুঘলদের প্রতিরোধ:
মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা যখন ঢাকার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে ওঠে, তখন মুঘল সুবেদার ইসলাম খান প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেন (শাসনকাল: ১৬০৮-১৬১৩)। তিনি বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে হাজীগঞ্জ দুর্গ, ইদ্রাকপুর কেল্লা ও সোনাকান্দা দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তী সুবেদার শায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৮৮) মগদের নির্মূলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনী গড়ে তোলেন এবং মগদের ঘাঁটি ধ্বংস করেন। এতে মগদের শক্তি ভেঙে পড়ে।
মগদের বসবাস:
দমন হওয়ার পরও কিছু মগ ও পর্তুগিজ নাবিক ঢাকায় থেকে যায়। অনেকে ভাড়াটে সৈন্য বা সাধারণ নাবিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে। এদের বসতিই মগবাজার নামকে স্থায়ী করে দেয়।
ব্রিটিশ আমলে পরিবর্তন:
১৮শ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে মগবাজার ধীরে ধীরে দস্যুদের আস্তানা থেকে আবাসিক এলাকায় রূপ নেয়। তখন এখানে ব্যবসায়ীদের ছোটো বড়ো কিছু বাজারও গড়ে ওঠে।
পাকিস্তান আমলে গুরুত্ব:
১৯৪৭ সালের পর মগবাজার ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ সময় এখানে বিখ্যাত মগবাজার ওয়্যারলেস গেট নির্মিত হয়, যা এলাকাটির পরিচিতি বাড়িয়ে দেয়।
আজ মগবাজার ঢাকার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা। আধুনিক ফ্লাইওভার, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা,বাণিজ্য সব মিলিয়ে এটি এখন রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র। তবুও এর নামের পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের এক ভুলে যাওয়া ইতিহাস।