অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলির ক্ষমতা পাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সব ক্ষমতা আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।

বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সভা হয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

আসিফ নজরুল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫‘ নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। অধ্যাদেশটি যখন চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে যাবে, তখন অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সবকিছু সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব বাজেট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা থাকবে; আর্থিক স্বাধীনতা থাকবে।

প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, তাঁদের কাছে মনে হয়েছে, কিছু বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে, তাই অর্থ উপদেষ্টার মতামতের প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন রয়েছে। সেই আলোচনার পর আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হবে।

উপদেষ্টা পরিষদ দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়াও অনুমোদন দিয়েছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, এটি হলে বাংলাদেশে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা বিদেশি হোন আর দেশি হোন, বাংলাদেশে অবস্থানকালে ভিন্ন দেশে দুর্নীতি করলেও এর তদন্ত দুদকের মাধ্যমে করা যাবে। সংশোধনীতে ‘জ্ঞাত আয়’ বলতে ‘বৈধ আয়’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির হাতে থাকবে। সচিব হবেন প্রশাসনিক প্রধান। সচিব পদে নিয়োগ পাবেন জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ। সচিব সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিবের সমমর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করবেন। সচিবালয় গঠিত হবে নির্দিষ্ট বিধির মাধ্যমে। এতে একজন সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয় থাকবে। অধ্যাদেশে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা আবশ্যক বলে বলা হয়েছে।

অধ্যাদেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মশর্ত নির্ধারণের বিধানও রাখা হয়েছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন বা বিধির ওপর এই অধ্যাদেশ প্রাধান্য পাবে। খসড়ায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণও দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের বিচার প্রশাসন পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করা, অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সচিবালয় হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে সব দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, ক্ষমতা ও গঠন নির্ধারণ করবে। এছাড়া, আদালত ও ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি ঠিক করবে।

অধ্যাদেশে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয়, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও পদায়ন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণসহ সব সাচিবিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেই সময় লক্ষ্য ছিল, বিচার বিভাগ রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পরও সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিন ধরে উঠছে আইনজীবী ও অংশীজনদের মধ্যে। এই দাবিকে বাস্তবে রূপ দিতে ২০০৭ সালের পর অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের উদ্যোগ নেয়।

সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব গত বছরের ২৭ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশনায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন একটি ধারণাপত্রসহ প্রস্তাবটি তৈরি করে। পৃথক সচিবালয় গঠন বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে আইন মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশ খসড়া করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আজ বৃহস্পতিবার এ অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে তুলে আলোচনা করছে।

জুলাই সনদের ৫২ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথক করতে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় গঠন করা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে। বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সচিবালয়কে সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থায়ন দেওয়া হবে। এছাড়া সচিবালয় অধস্তন আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাজেট প্রণয়ন, বিচারকের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পালন করবে। সব রাজনৈতিক দল ও জোট এ বিষয়ে একমত হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর আইন ও বিচার বিভাগে প্রশাসন ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা কাজ করবেন। এ বিধান অনুযায়ী গত ২৮ জুলাই আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫-এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে প্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়র সহকারী সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আইন উপকমিটির সদস্য তাজউদ্দিন আইন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থায় নির্বাহী পদে কর্মরত বিচারকদের বিচার বিভাগে প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।

তাজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিবের কাছে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থায় নির্বাহী পদে কর্মরত অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রত্যাহার করে তার স্থলে নির্বাহী বিভাগের আইন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে।

সরকার বনাম মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা ফৌজদারি আদালতসহ বিচার বিভাগীয় সব দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন কিন্তু তখন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা সরকারি ও নির্বাহী পদসমূহ পরিত্যাগ করেননি।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *