■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাণিজ্য চুক্তির রূপরেখা নিয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট। চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের বৈঠকে এই চুক্তির বিস্তারিত আলোচনা হবে।
বেসেন্ট মার্কিন গণমাধ্যম সিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, চুক্তিতে টিকটকের যুক্তরাষ্ট্র শাখা নিয়েও ‘চূড়ান্ত সমঝোতা’ হয়েছে। আর চীন তাদের বিরল খনিজ রপ্তানির কড়াকড়ি এক বছরের জন্য স্থগিত রাখবে।
বেসেন্ট আরও বলেন, ট্রাম্পের দেওয়া হুমকি অনুযায়ী চীনা পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। একই সঙ্গে চীন আবারও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি শুরু করবে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচকরা জানিয়েছেন, তারা শুল্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে একটি চুক্তির কাঠামোর বিষয়ে একমত হয়েছেন, যা এই সপ্তাহে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের প্রত্যাশিত বৈঠকের আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
“আমরা এখন এমন এক চুক্তির চূড়ান্ত বিশদ নিয়ে এগোচ্ছি, যা নেতারা (ট্রাম্প-শি জিনপিং) পর্যালোচনা করে চাইলে একসঙ্গে চূড়ান্ত করতে পারবেন,” আজ রোববার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সাংবাদিকদের বলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার।
তিনি আরও জানান, দুই পক্ষ চলতি বছর ধরে একাধিকবার যে শুল্কবিরতি করেছে, তার আরেকটি সম্প্রসারণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
চীনের প্রধান বাণিজ্য আলোচক লি চেংগ্যাং বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আলোচনা ছিল “খোলামেলা ও গভীর”, এবং উভয় পক্ষ একটি “প্রাথমিক ঐকমত্যে” পৌঁছেছে।
আলোচকরা মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় এক সপ্তাহের এশিয়া সফর শুরু করেন। বৃহস্পতিবার তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি আলাদা অর্থনৈতিক সম্মেলনে চীনের শীর্ষ নেতা শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কুয়ালালামপুরে আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার মধ্যে ছিল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, পারস্পরিক শুল্ক সম্প্রসারণ, ফেন্টানিল-সম্পর্কিত শুল্ক, এবং ফেন্টানিল পাচার মোকাবিলায় সহযোগিতা—চীনা পক্ষের তথ্যমতে।
গ্রিয়ার জানান, আলোচনায় বিরল খনিজ ধাতুও ছিল আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে, যেগুলোর প্রায় পুরো উৎপাদনই চীনে হয় এবং চলতি বছর বেইজিং এসব খনিজ রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। “আমরা শুল্ক বিরতি বাড়ানো, বিরল ধাতু, এবং আরও অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি,” তিনি বলেন।
অন্যদিকে, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এনবিসির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো”তে পৌঁছেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে চীন বিরল ধাতুর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে “কোনো ধরনের স্থগিতাদেশ” দিতে পারে। পাশাপাশি তিনি বলেন, এই কাঠামোতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকদের জন্যও সুবিধা রয়েছে।
গত শরতে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কেনা বন্ধ করেছে। এতে মাথায় হাত পড়েছে মার্কিন কৃষকদের। বিপুল শস্য এখন তাদের খাদ্যগুদামে। চীনের কাছে সয়াবিন বিক্রি পুনরায় চালু করাকে তাই গুরুত্ব দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
কুয়ালালামপুরে আলোচনায় আরও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি আরোপিত কঠোর বন্দর ফি, যা চীনে নির্মিত বা চীনা মালিকানাধীন জাহাজের ওপর বসানো হয়েছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীনও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি জাহাজের ওপর, এমনকি আমেরিকান কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীর মালিকানাধীন জাহাজের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে।
তবে উভয় পক্ষের আলোচকরাই সতর্কভাবে জানিয়েছেন যে, এখনো কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাননি তাঁরা।
“চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়পক্ষের উদ্বেগ মোকাবিলায় গঠনমূলকভাবে একটি পরিকল্পনা অন্বেষণ করেছে,” বলেন লি চেংগ্যাং। তিনি আরও বলেন, “এখন পরবর্তী ধাপ হলো প্রতিটি দেশের নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।”
লি যে “অভ্যন্তরীণ অনুমোদন প্রক্রিয়া”র কথা বলেছেন, সেটি চীনের প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে ইঙ্গিত করছে যে সেটা নীতিগত পদক্ষেপ হতে পারে। এর আগে গত ৯ অক্টোবর চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একগুচ্ছ নতুন রপ্তানি বিধান জারি করে, যা কার্যত বিরল ধাতু প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রযুক্তি চীন থেকে রপ্তানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়।
বিরল ধাতু উন্নত উৎপাদন খাতে অপরিহার্য — গাড়ি, সেমিকন্ডাক্টর, ড্রোন, শিল্প রোবট, সমুদ্রবাতাসচালিত টারবাইন থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, ট্যাংকসহ নানা সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে এগুলোর প্রয়োজন হয়। বিশ্বের মোট পরিশোধিত বিরল ধাতু ও ম্যাগনেটের ৯০ শতাংশই উৎপাদন করে চীন, এবং কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এ হার ১০০ শতাংশ পর্যন্ত।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪ এপ্রিল থেকে বিশ্বব্যাপী বিরল খনিজ ধাতু ও বিরল ধাতব চুম্বক রপ্তানিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। পরে ৯ অক্টোবর নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়, যা ৮ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়ার কথা। এই নিয়ম অনুযায়ী, চীনা উৎপত্তির বিরল ধাতব ম্যাগনেটযুক্ত যেকোনো পণ্যের রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হবে। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরির যন্ত্রপাতি রপ্তানিতেও সীমা টানা হবে—যে খাতে চীন তার বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত আধিপত্য ধরে রাখতে চায়।
নতুন বিধিনিষেধে আরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেমিকন্ডাক্টর ও সৌর প্যানেল তৈরিতে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি, যেমন হীরের তৈরি করাত (ডায়মন্ড স)। বেইজিং যদি এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা চীনা পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এমন প্রেক্ষাপটে বেসেন্ট, গ্রিয়ার ও লি—তিনজনই কুয়ালালামপুরের আলোচনার সার্বিক অগ্রগতিকে সতর্ক তবে আশাবাদী সুরে তুলে ধরেছেন।
রোববারের আলোচনার পর বেসেন্ট এনিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “নেতাদের (ট্রাম্প-শি) আলোচনার জন্য আমাদের এখন একটি খুবই কার্যকর কাঠামো তৈরি হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মূল কোম্পানি বাইটড্যান্সের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা বলে বিতর্ক চলছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। জনপ্রিয় এই অ্যাপের মালিকানাও কিনে নিতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন পর্যন্ত আলোচনার সুবিধার্থে চারবার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর স্থগিত করেছেন এবং সর্বশেষ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছেন।
