■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
আগামী ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সিটি নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র নির্বাচন। এ নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের তৎপরতা জোরদার হয়েছে। প্রধান প্রধান মেয়র প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচার চলছে সিটির প্রতিটি এলাকায়।
জোহরান মামদানি যে বিজয়ের দিকে এগোচ্ছেন, তার ইঙ্গিত আছে আগাম ভোটের মধ্যে। এরইমধ্যে গত রোববার পর্যন্ত ৭ লাখ ৩৫ হাজার বাসিন্দা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, যা আগের মেয়র নির্বাচনের ভোটপ্রয়োগের রেকর্ড। আরও ১ লাখ ৫১ হাজার চূড়ান্ত দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার ভোট দেবেন। আগাম ভোটের ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ পেয়েছেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুয়োমা পেয়েছেন ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
নিউইয়র্ককে বলা হয় অভিবাসীর শহর। সেখানে ৪০ শতাংশ মানুষের জন্ম অন্য দেশে। বাসিন্দাদের একাংশ ধনকুবের, অপর অংশ স্বল্প আয়ের। ধনী ও দারিদ্রের এ বিভেদ নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম দিক। ফিসকাল পলিসি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদন জানায়, বর্তমানে নিউইয়র্কের ১ শতাংশ মানুষ শহরটির আয়ের ৪৪ শতাংশের ভোগ করছেন। এটা হার ৩০ বছর আগের তুলনায় চারগুণ বেশি। মামদানি ও সোস্যাল ডেমোক্র্যাট বার্নি স্যান্ডান্ড এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে চান।
নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির যারা আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় ও সচেতন, তারাও মেয়র নির্বাচনে তাদের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখছেন। কারণ এবারের সিটি মেয়র নির্বাচনে প্রধান তিন প্রার্থীর মধ্যে কোনো কোনো জরিপে এগিয়ে আছেন উগান্ডায় জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান জোহরান মামদানি। সিটির শীর্ষপদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ তিনিই প্রথম মুসলিম। জোহরান মামদানি বর্তমানে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির একজন সদস্য। সিটির বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি অধ্যুষিত এলাকাগুলো মামদানির প্রচারণায় মুখর।
বর্তমান মেয়র, অর্থাৎ সিটির ১১০তম মেয়র এরিক অ্যাডামস পুনঃনির্বাচনের জন্য প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। সিটির ৩৬০ বছরের মেয়রের তালিকায় এরিক অ্যাডামস দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র, যিনি ২০২১ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র ছিলেন ডেভিড নরম্যান ডিনকিনস, যিনি সিটির ১০৬তম মেয়র হিসাবে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুস গ্রহণ, নির্বাচনি প্রচারণা পরিচালনার বিদেশি নাগরিকের কাছে অবৈধভাবে তহবিল সংগ্রহসহ পাঁচটি ফৌজদারি অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এফবিআই’র তদন্তের মুখোমুখি হন।
জোহরান মামদানি নির্বাচিত হলে তিনি হবেন শহরটির ভারতীয় বংশদ্ভূত প্রথম মুসলিম মেয়র। বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা গেছে, অভিবাসী বাবা-মায়ের এ সন্তান এখন পর্যন্ত অসাধারণ জনসমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে তার জয়ের সম্ভবনা বেশি। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা হলেও সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় প্রভাবিত। জন্ম ১৯৯১ সালে উগান্ডার কাম্পালায়। বাবা গুজরাটি মুসলিম অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি খ্যাতিমান লেখক ও শিক্ষাবিদ; মা ভারতীয় বংশদ্ভূত বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ার।
মামদানি নির্বাচনী প্রচারে ছোট ছোট ভিডিও বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জবি ভাষায় ভোটারদের আকৃষ্ট করেন। নিজে অভিবাসী হওয়ায় নিউইয়র্কের অভিবাসীরা তার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক খোঁজে পান। সে জন্য শত শত সেচ্ছাসেবী মাঠে নেমেছেন মামদানির প্রচারে, যেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক মেয়র ডেমোক্র্যাট দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এন্ড্রু কৌমোকে অনেকটাই নিস্প্রভ দেখাচ্ছে। গত জুনে অনেকটা চমক সৃষ্টি করে কৌমোকে হারিয়ে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে জয় পান মামদানি। তার পক্ষে প্রচারণার মাঠে লড়ছেন ৪৭ বছরের লেখক রবার্ট উড। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘বার্তাটি সহজ— ক্রয়ক্ষমতা দিকে নজর দাও।’
শেষ সময়েও ইহুদিদের মন জয়ের চেষ্টা
নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচনের ঠিক আগে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী একটি অংশের সমর্থন পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানি। তবে এই সমর্থনকে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়টির নেতাদের মধ্যে বিভক্তিও প্রকাশ্যে এসেছে। ওই গোষ্ঠীর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুয়োমাকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ জানিয়েছে, নিউইয়র্কে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে হাসিদি সম্প্রদায়ের আহরোনিম গোষ্ঠীর এই বিভক্তি নিউইয়র্কের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
গাজায় ইসরায়েলি অভিযান নিয়ে সমালোচনামুখর হওয়ায় জোহরান মামদানির ওপর অনেক ইহুদি ভোটার নাখোশ। এমন পরিস্থিতিতে ইহুদিদের একটি কট্টরপন্থি গোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়াকে মামদানির জন্য বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সমর্থন পেয়ে জোহরান মামদানি তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘আজ উইলিয়ামসবার্গে ইহুদি ধর্মীয় নেতা ও একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সমর্থন পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি। আমরা একসঙ্গে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়ব। নিউইয়র্ক নগরীকে সবার বসবাসের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলবো।’
অন্যদিকে, কুয়োমোর ভ্যারিফাইড এক্স অ্যাকাউন্টে বলা হয়—’সাতমার সম্প্রদায়ের (ওই ইহুদি গোষ্ঠীর মূল পরিচয়) ভালো বন্ধুরা আমাকে সমর্থন দেওয়ায় আমি সম্মানীত বোধ করছি।’
সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিউইয়র্কের ভোট নিয়ে ইহুদিদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ প্রকাশ্যে এলেও যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো জোহরান মামদানির প্রতি ইহুদিদের সমর্থন ক্রমশই বাড়ছে। নিউইয়র্কের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি গোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়ার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ওই প্রার্থীকে উজ্জ্বীবিত করবে।
নিউইয়র্কের রাজনীতিতে এই ইহুদি গোষ্ঠীটি বেশ প্রভাবশালী। ২০১৩ সালে তাদের প্রায় সাড়ে সাত হাজার ভোটের জোরেই ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে মেয়র পদে বিল ডি ব্লাসিও মনোনয়ন পেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ফলে তাদের সমর্থন যেকোনো প্রার্থীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মামদানি মেয়র হলে তহবিল বন্ধের হুমকি ট্রাম্পের
এই সপ্তাহে আমেরিকার বৃহত্তম শহর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে যদি বামপন্থী প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জোহরান মামদানি নির্বাচিত হলে নিজ শহরকেই ফেডারেল তহবিল দিতে অনিচ্ছুক হবেন বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমার জন্য নিউইয়র্ককে প্রচুর অর্থ দেওয়া কঠিন হবে, কারণ নিউইয়র্ক যদি একজন কমিউনিস্ট পরিচালনা করেন, তবে আপনি সেখানে যে অর্থ পাঠাচ্ছেন তা কেবলই অপচয় করছেন।’
ট্রাম্প প্রশাসন বারবার ডেমোক্র্যাট-শাসিত অঞ্চলে অবস্থিত প্রকল্পগুলোর জন্য ফেডারেল অনুদান ও তহবিল কমানোর চেষ্টা করেছে।
ভোটের প্রাক্কালে জনমত জরিপগুলো মঙ্গলবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, মামদানি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর থেকে এগিয়ে আছেন।
মামদানি জিতলে তহবিল সম্পর্কে তার মন্তব্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ট্রাম্প দেননি। এই অর্থবছরে নিউইয়র্ক সিটি ৭.৪ বিলিয়ন ডলার ফেডারেল তহবিল পেয়েছিল।
সিবিএসের ৬০ মিনিটস অনুষ্ঠানে একটি বিস্তৃত সাক্ষাৎকারে রবিবার ট্রাম্প বলেন, মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে বামপন্থী সাবেক নিউইয়র্ক সিটি মেয়র বিল দে ব্লাসিওকেও ‘খুব ভালো দেখাবে।’
মামদানি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি দে ব্লাসিওকে দেখেছি তিনি কতটা খারাপ মেয়র ছিলেন, আর এই ব্যক্তি দে ব্লাসিওর চেয়েও অনেক খারাপ কাজ করবেন।’
নিউইয়র্কের কুইন্স বরোতে বেড়ে ওঠা ট্রাম্প এই সাক্ষাৎকারে কার্যকরভাবে একজন ডেমোক্র্যাট হওয়া সত্ত্বেও কুওমোকে সমর্থন করেন।
এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি কুওমোর ভক্ত নই, তবে যদি খারাপ একজন ডেমোক্র্যাট এবং একজন কমিউনিস্টের মধ্যে নির্বাচন হয়, তবে সত্যি বলতে আমি সব সময় খারাপ ডেমোক্র্যাটকেই বেছে নেব।’
